অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম খুলনায় সবচেয়ে বেশি

>
  • ‘ল্যানসেট’–এর প্রবন্ধ
  • অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেওয়া নারীর পরবর্তী সন্তান মৃত বা অপরিণত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
  • এসব শিশুর অ্যালার্জি ও অ্যাজমার ঝুঁকি থাকে।
  • অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম খুলনায় সবচেয়ে বেশি
  • বিশ্বে ২১%
  • বাংলাদেশে ৩০.৭%
  • খুলনায় ৪৩%
  • সিলেটে ১৯%

বিশ্বে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সন্তানের জন্ম হয়, এমন ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম এসেছে। দেশে খুলনা বিভাগে এমন অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার সবচেয়ে বেশি, ৪৩ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ১৯ শতাংশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট এ তথ্য দিয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গর্ভকালে সমস্যা বা প্রসব জটিলতার কারণে মা ও সন্তানের জীবন রক্ষায় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। একটি জনগোষ্ঠীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সন্তান প্রসবে অস্ত্রোপচারের দরকার হতে পারে। এই হারের বেশি হলে তা অপ্রয়োজনীয়। ২০১৬ সালের তথ্য উদ্ধৃত করে ল্যানসেট বলছে, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৩০ শতাংশের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে।

অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের বৈশ্বিক প্রবণতা নিয়ে গত শুক্রবার ল্যানসেট তিনটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। প্রবন্ধ তিনটির তথ্য এদিন ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকলজি অ্যান্ড অবসটেট্রিকস ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে প্রকাশ করা হয়। তালিকায় প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান আছে। এ ছাড়া অন্য দেশের মধ্যে আছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল।

ল্যানসেট বলছে, ২০০০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্বে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার প্রায় দুই গুণ বেড়েছে। ২০০০ সালে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার ছিল ১২ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২১ শতাংশ। বিশ্বের ৬০ শতাংশ দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অস্ত্রোপচার হচ্ছে। আবার একই দেশের মধ্যে ধনী-দরিদ্র ও অঞ্চলভেদে এই প্রবণতার পার্থক্য আছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও অস্ত্রোপচারের হারের মধ্যে পার্থক্য আছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি
বাংলাদেশেও সব অঞ্চলে সমানভাবে শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার হয় না। খুলনা বিভাগে শিশু জন্মে অস্ত্রোপচারের হার কেন বেশি, এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তারা কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি) মোহাম্মদ শরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলে কেন অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার বেশি, তার সঠিক কারণ এই মুহূর্তে আমাদের জানা নেই। তবে আমরা তা জানার চেষ্টা করছি।’

অবশ্য খুলনা জেলার সিভিল সার্জন আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে ২৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। অন্য দিকে বেসরকারি ক্লিনিকে ৮০-৯০ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে রোগী নিজে বা তাঁর আত্মীয় অস্ত্রোপচার করাতে চান। এতে অস্ত্রোপচারের হার বাড়ে। এই হার আরও বেড়ে যায় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে।

বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার দ্রুত বাড়ছে। ২০০১ সালে এই হার ছিল ৪ শতাংশের নিচে। ২০১০ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপে দেখা যায়, ওই হার বেড়ে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ল্যানসেট ২০১৬ সালের জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে বলছে, বর্তমানে তা ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। অনুমিত হিসেবে দেশে বছরে প্রায় ১০ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।

বিশ্বব্যাপী অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ল্যানসেট। সাময়িকীটির সম্পাদকীয়তে অস্ত্রোপচারের বর্তমান হারকে নজিরবিহীন ও অন্যায্য বলেছে।

গবেষকেরা বলছেন, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় অস্ত্রোপচারের সন্তান জন্ম দেওয়া মায়েদের মৃত্যুহার ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেওয়া নারীদের জরায়ু ফেটে যাওয়া, অস্বাভাবিক স্থানে গর্ভফুলের অবস্থান ও গর্ভ সঞ্চার, মৃত বা অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার প্রবণতা বেশি। অস্ত্রোপচারে জন্ম নেওয়া নবজাতকের শারীরিক কিছু পরিবর্তনও ঘটে। এদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে, অ্যালার্জি ও অ্যাজমার প্রবণতা বাড়ে। বয়স বাড়লে কৈশোরের শেষ দিকে স্থূল বা অতি মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি।

অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্মের হার বৃদ্ধি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ লক্ষ করা গেছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রতিটি প্রসবের জন্য নির্দিষ্ট ফরম তৈরি করা হচ্ছে। ওই ফরমে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে লিখতে হবে, কেন অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে।

সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের ৩ হাজার ১৩১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ২ হাজার ৮০০ কেন্দ্রে সেবা চালু হয়েছে। এসব কেন্দ্রে সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা প্রসবসেবা দেওয়া হচ্ছে।