ইসির বিরোধ নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে?

>

• একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচন
•  নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল হতে পারে
• ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে
• অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে না চাওয়ায় ইসি প্রশ্নের মুখে
 • বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই

জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মুহূর্তে নিজেদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিজেদের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় এই ইসি কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। তবে ইসি এই বিরোধকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, মতবিরোধ থাকলেও নির্বাচন পরিচালনা তাদের জন্য কঠিন হবে না।

নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের পাশাপাশি সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি, পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মতো বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে না চাওয়া এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এর ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় আরও বাড়বে। তা ছাড়া ইসির বর্তমান অবস্থান এই বার্তা দিচ্ছে যে জাতীয় নির্বাচনে ইসি নিজের ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগে খুব একটা আগ্রহী নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচন। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপিসহ কয়েকটি দল। আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীরা বাদে গত নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো এখনো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ অবস্থায় কোনো দলের কথা না শুনেই, এমনকি একজন নির্বাচন কমিশনারের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে জাতীয় নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে ইসি। আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল এবং ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতে নির্বাচন হতে পারে।

এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংলাপ করেছিল। কিন্তু সংলাপের সুপারিশগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেনি। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংলাপের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে পাঁচটি প্রস্তাব তৈরি করে গত সোমবার ইসির বৈঠকে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্য কমিশনারদের আপত্তির কারণে তিনি প্রস্তাবগুলো সভায় তুলতে পারেননি। পরে তিনি বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ এনে সভা বর্জন করেন।

মাহবুব তালুকদারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘ওটা নিয়ে পত্রপত্রিকা, টিভিতে প্রচার হয়েছে। নো কমেন্ট। আমাকে আর ইনসিস্ট করবেন না, আমি আর কথা বলব না।’

কমিশনের মধ্যে মতবিরোধ রেখে জাতীয় নির্বাচন করা কঠিন হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, কঠিন হবে না।

আগের দিন বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ এনে বৈঠক বর্জন করলেও গতকাল সকালে সিইসির দপ্তরে যান মাহবুব তালুকদার। পরে পাঁচ কমিশনার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০ অক্টোবর ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন মাহবুব তালুকদার। ৩০ অক্টোবর তাঁর ফেরার কথা রয়েছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনে মতবিরোধ থাকতে পারে। কোনো একজন বা একাধিক কমিশনার কোনো বিষয়ে ভিন্ন মত রাখতে পারেন। তবে অধিকাংশ কমিশনার যে মত দেবেন, সেটাই গ্রহণযোগ্য হবে এবং ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবাই এক হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু সভা বর্জন করার মতো ঘটনার নজির আগের কমিশনগুলোতে নেই। এ ধরনের ঘটনা বিভ্রান্তি তৈরি করে।

বর্তমান কমিশনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হয় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমান কমিশনের পাঁচ সদস্য শপথ নেন। এরপর জুলাইয়ে ইসি সচিবালয়ের ৩৩ জন কর্মকর্তার বদলি নিয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। এরপর জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, সিটি নির্বাচনে সাংসদদের প্রচারের সুযোগ দেওয়া, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইসির মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও কমিশনে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে মূলত মতবিরোধ দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের।

এর বাইরে সিইসির সঙ্গে চার কমিশনারেরও মতবিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে কয়েকটি ঘটনায়। সম্প্রতি সিইসি বলেছিলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। তাঁর এই বক্তব্যের পর অন্য চার কমিশনার গণমাধ্যমে বলেছিলেন, এটা কমিশনের বক্তব্য নয়, সিইসির নিজস্ব মত। গত মাসে ইসির কর্তৃত্ব নিয়ে চার কমিশনারের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।

নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও নির্বাচনের দৈনন্দিন প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে ইসি। গতকাল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনারেরা। বৈঠক শেষে সিইসি কে এম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি সন্তোষজনক। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁরা স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সবার জন্য সমান সুযোগ নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। তফসিল ঘোষণার পর জানা যাবে, সরকারের বা সংসদ সদস্যদের অবস্থান কী থাকবে। তবে আচরণবিধিতে কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেবে ইসি।

 সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে যেসব নির্বাচন কমিশনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল, সেসব কমিশন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবে ইসি কাজ করতে পারেনি। এখন ইসির বিরোধ বড় আকার ধারণ করছে। দলনেতা হিসেবে সমন্বয়ের দায়িত্ব সিইসির। সংবিধানে যে প্রতিষ্ঠানটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানে এত বিভাজন থাকলে ভোটারদের আস্থার জায়গা থাকবে না।