মাহবুব তালুকদারকে চাপে রাখার কৌশল

কমিশনের বৈঠকে মাহবুব তালুকদারের লিখিত আপত্তি ও সভা বর্জনের প্রতিক্রিয়া
কমিশনের বৈঠকে মাহবুব তালুকদারের লিখিত আপত্তি ও সভা বর্জনের প্রতিক্রিয়া
>
  • মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য বাইরে আসায় ইসি সমালোচিত
  • তবে ইসি বিব্রতকর অবস্থা অনুভব করছে না, ঐক্যও নষ্ট হয়নি
  • মাহবুব তালুকদারকে নিয়ে ভবিষ্যতেও ঝামেলার আশঙ্কা
  • নির্বাচন কমিশনার মাহবুবের পদত্যাগ দাবি ১৪ দলের

জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আরও বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করতে পারেন—এমন আশঙ্কা করছে সরকার। এ কারণে সরকারি দল তাঁর ওপর চাপ তৈরি করার কৌশল নিয়েছে। ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোট মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগের দাবি তুলেছে।

তবে সরকার মনে করছে, কমিশনারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। সে ক্ষেত্রে একা মাহবুব তালুকদার খুব বেশি কিছু করতে পারবেন না। তবু তিনি গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরায় বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। সরকারের সমালোচক ও বিরোধী দলগুলো এর সুযোগ নেবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ইসিকে নিয়ে ভাবতে হয়নি আওয়ামী লীগকে। এবার একজন কমিশনারকে নিয়ে কিছুটা ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। কোনো কোনো নির্বাচন কমিশনারও মনে করেন, মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য কমিশনের বৈঠকের বাইরে আসায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সমালোচিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিক পদ হওয়ায় নির্বাচনের আগে প্রকাশ্য চাপ তৈরি করতে গিয়ে বিতর্ক বাড়বে। এটিও তাদের চিন্তায় আছে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের কেউ কেউ চান নির্বাচন কমিশনের ভেতর থেকে মাহবুব তালুকদারের ওপর চাপ তৈরি হোক। এই নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য গত বছরের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। দলগুলোর কাছ থেকে নামও নেওয়া হয়েছিল। পরে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ১০টি নাম নিয়ে সেখান থেকে ৫ সদস্যের কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। কমিশন গঠনের পর থেকে কমিশন, বিশেষত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার কঠোর সমালোচনা করে আসছে বিএনপি। বিভিন্ন সময় তারা সিইসির পদত্যাগ ও কমিশন পুনর্গঠনেরও দাবি জানিয়েছে। এবার নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগের দাবি তুললেন ক্ষমতাসীনেরা। এ ধরনের ঘটনা বিরল।

গতকাল বুধবার ১৪ দলের বৈঠকে মাহবুব তালুকদারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে ১৪ দলের একাধিক নেতা বলেন, ড. কামাল হোসেন একবার বলেছেন যে নির্বাচন হবে না। নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র আছে। মাহবুব তালুকদারের এই তৎপরতার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

বৈঠক শেষে জোটের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মাহবুব তালুকদারের পদত্যাগের দাবি জানান। তিনি বলেন, যাঁরা সাংবিধানিক পদে রয়েছেন, তাঁদের যেকোনো বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। তিনি এটা খুবই অন্যায় করছেন। এ ধরনের পদে থেকে এ ধরনের আচরণ তাঁর করা উচিত নয়। অন্যথায় তাঁর পদটি ছেড়ে দেওয়া উচিত।

গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির কথায় বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১৪ দলের মুখপাত্র বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি সরকার দেশ পরিচালনা করবে। বিএনপি-জামায়াত নতুন সাথি নিয়ে অযৌক্তিক দাবি তুলে অশুভ চক্রান্ত শুরু করেছে। কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তারা একটি অভিলাষ নিয়ে মাঠে নেমেছে।

গত সোমবার মাহবুব তালুকদার বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের সভা বর্জন করেন। তিনি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসির সংলাপ থেকে আসা সুপারিশগুলোর আলোকে পাঁচ দফা প্রস্তাব তৈরি করেছিলেন। তিনি এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্য কমিশনারদের আপত্তির কারণে তা তুলতে পারেননি। পরে তিনি আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়ে সভা বর্জন করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।

আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, মাহবুব তালুকদার সভা বর্জন করে সাংবাদিকদের ব্রিফ করায় ইসির জন্য তা বিব্রতকর হয়েছে বলে একটা বার্তা ছড়িয়েছে। তবে কমিশন তা অনুভব করছে না। কমিশনের ঐক্য নষ্ট হয়নি। তিনি মনে করেন, মাহবুব তালুকদার যে প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নেই। একটি প্রস্তাব অসাংবিধানিক।

মাহবুব তালুকদারের পাঁচ প্রস্তাবের বিষয়ে কবিতা খানম বলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনার সময় এখনো আসেনি। স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনার প্রস্তাব সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর সরকারের সঙ্গে ইসির আলোচনার প্রয়োজন তিনি দেখছেন না। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একবার সংলাপ হয়েছে। তাই আবার সংলাপ করার মতো পর্যাপ্ত সময় ইসির হাতে নেই।

সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের বিষয়ে কবিতা খানম বলেন, ইসি সংবিধান অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সংসদ বহাল থাকবে কি থাকবে না, তা ইসির এখতিয়ার নয়।

মাহবুব তালুকদারের সভা বর্জনের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে কবিতা খানম বলেন, তিনি মনে করেন না এর মধ্য দিয়ে কমিশনে কোনো অনৈক্য তৈরি হয়েছে। যে কেউ যেকোনো সিদ্ধান্তে ভিন্নমত দিতে পারেন। এই মতবিরোধের কারণে কমিশনে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতেই কমিশনের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের মতবিরোধ এই প্রথম নয়। নীতি নির্ধারণী বিষয়ে এর আগেও এই মতবিরোধ সামনে এসেছে। মূলত ক্ষমতাসীনদের চাওয়া পূরণের পথে ইসির পদক্ষেপে আপত্তি তুলেছিলেন মাহবুব তালুকদার।

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দাবি জানিয়েছিল, সিটি নির্বাচনে সাংসদের প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। এরপর তড়িঘড়ি করে আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয় ইসি। তখন কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিলেন মাহবুব তালুকদার।

জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার পক্ষে আওয়ামী লীগ। ইসির সংলাপে তারা এই মত জানিয়েছিল। বিপরীতে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল এর বিপক্ষে। এই প্রেক্ষাপটে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পথ সুগম করতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগেও আপত্তি জানান মাহবুব তালুকদার। যেদিন আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব ইসি অনুমোদন করেছিল, সেদিনও মাহবুব তালুকদার ভিন্নমত দিয়ে সভা বর্জন করেছিলেন।