তোমাকে ভুলবে না বাংলাদেশ

ফাদার রিগনকে সমাহিত করার আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। গতকাল মোংলা উপজেলা পরিষদ মাঠে।  ছবি: প্রথম আলো
ফাদার রিগনকে সমাহিত করার আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। গতকাল মোংলা উপজেলা পরিষদ মাঠে। ছবি: প্রথম আলো
>

• মৃত্যুর একবছর পর ইতালি থেকে রিগনের মরদেহ আনা হয়
• রিগন চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তাঁকে বাংলায় সমাহিত করা হোক
• ধর্ম প্রচার ও সেবার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন রিগন

ইতালির নাগরিক হয়েও যিনি মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে ভালোবেসেছিলেন, যিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর এই বাংলায় তাঁকে সমাহিত করা হোক, সেই ফাদার মারিনো রিগনকে পরম শ্রদ্ধায় মোংলার মানুষ সমাহিত করল শেলাবুনিয়া গ্রামে তাঁরই হাতে গড়া সেন্ট পলস গির্জার পাশে।

গত বছরের ২০ অক্টোবর (১৯২৫-২০১৭) ৯২ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ইতালিতে তিনি মারা যান। এক বছর পর তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ইতালি থেকে রিগনের মরদেহ বাংলাদেশে আনা হয়।

 মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখানে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। পরে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, ফাদার রিগনের ভাগনে মারিও কাভেস্ত্রো, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং মোংলা ও রামপাল উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে শেষবারের মতো বিনম্র শ্রদ্ধা জানান।

এরপর দুপুর ১২টায় ফাদার রিগনের গড়ে তোলা সেন্ট পলস হাসপাতাল ও সেন্ট পলস উচ্চবিদ্যালয়ে আনা হয় তাঁর মরদেহ। ধর্মীয় আচার শেষ করে বেলা তিনটায় সেন্ট পলস গির্জার সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

ইতালি থেকে ফাদার রিগন বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৫৩ সালে। উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম প্রচার ও মানুষের সেবা করা। বাংলাদেশে আসার পর থেকে ৬১ বছর ধরে নিরলসভাবে মানবকল্যাণে কাজ করে গেছেন। অসুস্থ হয়ে ২০১৪ সালে ইতালি যান। এই ছয় দশকে শিক্ষাবিস্তারে অবদান ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অসামান্য ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের মানুষের মনের খুব গভীরে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর গভীর টান।

ফাদার মারিনো রিগন
ফাদার মারিনো রিগন

১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে আসার পর বিশপ দান্তে নির্দেশ দিলেন মোংলায় গিয়ে একটি উচ্চবিদ্যালয় আর একটি চার্চ প্রতিষ্ঠার জন্য। এই সিদ্ধান্তই রিগনের জীবনে নতুন পরিবর্তন নিয়ে এল। তিনি স্থায়ী নিবাস গড়ে তুললেন সুন্দরবনসংলগ্ন মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। তাঁর কর্মসঙ্গী সেন্ট পলস উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ফ্রান্সিস সুদান হালদার জানান, এই মানুষটি মোংলার সেন্ট পলস উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় নিজে মাথায় করে ইট বয়েছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তাঁর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও হাজার হাজার দরিদ্র ছাত্রছাত্রীকে স্পনসরশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কাজের সুবিধার্থে বাংলা শিখতে গিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রেমে পড়ে যান। তাঁর হাত দিয়ে ইতালিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ অনেক কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের অসংখ্য গান, জসীমউদ্‌দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, শরৎচন্দ্রের পণ্ডিত মশাই, চন্দ্রনাথ ইত্যাদি। এ ছাড়া ইতালীয় নন্দিত রূপকথা পিনোকিও অনুবাদ করেছেন বাংলায়।

 একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা, বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী এই বিদেশি বন্ধুকে ২০১২ সালে মৈত্রী সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ সরকার। এর আগে ২০০৮ সালে ফাদার রিগনকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে ইতালি যাওয়ার আগে এই প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, যে দেশে রবীন্দ্রনাথ আছে, লালন আছে, নজরুল আছে, জসীমউদ্‌দীন আছে সেই দেশ কখনো পিছিয়ে থাকতে পারে না।’

ফাদার রিগন—এ দেশের বড় আপনজন ছিলে তুমি। তোমাকে ভুলবে না বাংলাদেশ।