আতঙ্কের নারায়ণগঞ্জে সড়কে আরও লাশ

>

• গত সাত দিনে নারায়ণগঞ্জে ৭ লাশ উদ্ধার
• এসব ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে আতঙ্ক বেড়েছে
• তিন অপহৃত ফিরেছেন, নির্যাতনের অভিযোগ
• অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ

নারায়ণগঞ্জের চার খুনের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করার কথা জানায়নি পুলিশ। এর মধ্যেই গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে এক ব্যক্তির ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়া গেছে, যার পরনে কোনো কাপড় ছিল না বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। এই নিয়ে গত সাত দিনে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সড়কের পাশ থেকে সাতটি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরপর এসব ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ১৬ ঘণ্টা পর নারায়ণগঞ্জের যুবলীগের নেতা ও তাঁর দুই সহযোগীকে গতকাল ঢাকা ও গাজীপুরের পৃথক দুটি স্থানে হাত-পা বেঁধে ফেলে গেছে অপহরণকারীরা। কারা, কেন তাঁদের ধরে নিয়েছিল, এ বিষয়ে কিছু বলেননি ফিরে আসা ব্যক্তিরা।

গত বুধবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া (৪৫) ও তাঁর সহযোগী ছাত্রলীগের কর্মী সাকিল ভূঁইয়া এবং যুবলীগ কর্মী সাকিল মিয়াকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগ, অপহরণকারীরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এর তিন দিন আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানা এলাকার মহাসড়কে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়, যাঁদের মধ্যে তিনজনকে ‘ডিবি’ পরিচয়ে দুই দিন আগে পুরিন্দা এলাকার একটি বাসা থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল।

এর আগে ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। পরে তাঁকে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর অপহরণের রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়নি।

বুধবার যুবলীগের নেতাসহ তিন নেতা-কর্মীকে তুলে নেওয়ার পরপরই সন্ধ্যায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নারায়ণগঞ্জের ভুলতা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা বাইপাস সড়কে প্রায় তিন ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ করে রাখেন। অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা।

এরপর গতকাল ভোরে সাভারের আশুলিয়ায় যুবলীগের নেতা শফিকুরকে এবং গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে সাকিল ভূঁইয়া ও সাকিল মিয়াকে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা।

ফিরে আসার পরে যুবলীগের নেতা শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাদাপোশাকে একদল অস্ত্রধারী তাঁদের মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে তাঁদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। গাড়িতে করে সারা রাত বিভিন্ন স্থানে ঘোরানো হয়। গাড়ির ভেতরে তাঁদের হাত-পা, চোখ বেঁধে উপর্যুপরি নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তিনবার ‘কলেমা’ পড়ানো হয়। পরে ভোরে তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় অপহরণকারীরা।

শফিকুরের স্ত্রী নার্গিস সুলতানা জানান, তাঁর স্বামীকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে। উদ্ধারের পর তাঁকে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

দিনদুপুরে তিনজনকে তুলে নেওয়ার ঘটনার কোনো সুরাহা করতে পারেনি পুলিশ। রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, ভোরে সাভারের আশুলিয়া এলাকায় যুবলীগের নেতা শফিকুরকে হাত বেঁধে গাড়ি থেকে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা। তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

ওসি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হলেও পুলিশের কোনো ইউনিট তাঁদের আটক বা গ্রেপ্তার করেনি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ঘটনায় কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, কারা, কেন, কী কারণে তাঁদের অপহরণ করেছিল, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

আরও লাশ:
গত রোববার নারায়ণগঞ্জের সড়কে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এই চার খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের গঠিত কমিটি চার খুনের ঘটনাস্থল গতকাল পরিদর্শন করেছে।

চার খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামসংলগ্ন পুলিশ চেকপোস্টের দুই শ গজের মধ্যে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাশ পাওয়া গেছে। জালকুড়ি এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে লাশটির দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মাথার চুল দেখে ধারণা করা হচ্ছে মধ্যবয়সী কোনো পুরুষের লাশ। তবে লাশ উদ্ধারের সময় তাঁর শরীরে কোনো পোশাক পাওয়া যায়নি। তবে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নজরুল ইসলাম বলেন, এটা হত্যা না দুর্ঘটনা লাশ দেখে বোঝার উপায় নেই।

গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, লিংক রোডের ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জগামী সড়কের পাশজুড়ে ময়লার স্তূপের পাশেই সড়কে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে লাশের বিভিন্ন অংশ। স্থানীয় একটি পোশাক কারখানার প্রহরী মোর্শেদুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান বলেন, সকাল থেকে লোকজন বলাবলি করছিল কারা যেন সড়কে লাশ ফেলে গেছে।

লাশ উদ্ধারের সময় উপস্থিত স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ বলেন, এটা দুর্ঘটনা বলে মনে হয় না। দুর্ঘটনা হলে তো নিহত ব্যক্তির শরীরে অন্তত পোশাক থাকত। 

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ ও সংবাদদাতা নারায়ণগঞ্জ)