পাহারা দিয়েও জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখা যায়নি

নরসিংদীর মাধবদীতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ।  ফাইল ছবি
নরসিংদীর মাধবদীতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। ফাইল ছবি
>

• জঙ্গি তৎপরতা
• পরিবারের সদস্যদের বোকা বানিয়ে বাসা ছাড়েন তিন ছাত্রী।
• ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে নব্য জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার দুজনের।

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে দুই বছর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তিন ছাত্রী। গ্রেপ্তার হওয়ার তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁরা জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর থেকে তিন পরিবারই কঠোর নজরদারিতে রেখেছিল তিন ছাত্রীকে। একাকী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারতেন না তাঁরা। সব সময় কেউ না কেউ সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু চলতি অক্টোবর মাসের শুরুতে তাঁরা কাউকে কিছু না বলে বাসা ছাড়েন। এত পাহারা দিয়ে রাখার পরও আবারও কীভাবে তাঁরা জঙ্গিবাদে জড়ালেন, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছে না তিনটি পরিবার।

ওই তিন ছাত্রীর মধ্যে আকলিমা রহমান ওরফে মণি ১৫ অক্টোবর নরসিংদীতে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন। অভিযানে তাঁর স্বামীও মারা যান। অভিযানে ধরা পড়েন ইশরাত জাহান ওরফে মৌ ও খাদিজা পারভীন ওরফে মেঘলা। গতকাল বৃহস্পতিবার সাত দিনের রিমান্ড শেষে দুজনকে আদালতে নেওয়া হয়। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে তাঁরা নব্য জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন।

ইশরাতের বাসা রাজধানীর মিরপুর, আকলিমার বাসা গাজীপুরের বোর্ডবাজার এবং খাদিজার বাসা আশুলিয়ায়। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

নরসিংদীতে ইশরাত ও খাদিজাকে জিজ্ঞাসাবাদে নরসিংদী জেলা পুলিশকে সহযোগিতা করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম। কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলের ওই তিন ছাত্রী। তাঁদের মধ্যে আকলিমা প্রথমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরে ইশরাত ও খাদিজা জঙ্গি তৎপরতায় জড়ান। কারাগার থেকে প্রথম দফায় ছাড়া পাওয়ার পর কিছুদিন জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু কয়েক মাস আগে নব্য জেএমবির সঙ্গে অনলাইনে আবার যোগাযোগ করেন আকলিমা। তারপর ইশরাত ও খাদিজাকে নারায়ণগঞ্জের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি মুঠোফোন অ্যাপ টেলিগ্রামে ‘দ্বীনি বোন’দের একটি গ্রুপে তিনজনকেই যুক্ত করেন। গত সেপ্টেম্বরে খাদিজা নারায়ণগঞ্জের সেই যুবককে বিয়ে করেন। আর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তিনজনই গিয়ে ওঠেন নরসিংদীতে।

কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে খাদিজা ও ইশরাত বলেছেন, তাঁরা কেউই তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ওই তিন ছাত্রী নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীকেন্দ্রিক একটি জঙ্গি নেটওয়ার্কে যুক্ত ছিলেন। এই দলে ১০–১২ জন রয়েছেন। তাঁদের খোঁজা হচ্ছে এখন।

আকলিমার পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে গতকাল কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, আকলিমার লাশ আনতে তাঁরা নরসিংদী যাননি। লাশ আনবেনও না। পরিবারের ছোট মেয়ে এভাবে সবাইকে ধোঁকা দেবেন, এটি তাঁদের কল্পনায়ও ছিল না। ওই আত্মীয় বলেন, জামিনে মুক্তির পর আকলিমার বৃদ্ধা মা মেয়েকে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যেতেন। পরিবারের দাবি, তাঁরা যখন পাত্র খুঁজছেন, তখন আকলিমার এক বন্ধু মাসুম নামের এক যুবকের প্রস্তাব পাঠান। প্রকৃতপক্ষে মাসুম নব্যজেএমবির মিডিয়া শাখার দায়িত্বে থাকা আবু আবদুল্লাহ। এই তথ্য আকলিমা ও তাঁর বন্ধুরা চেপে গিয়েছিলেন। গত মে মাসে আকলিমার বিয়ে হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বলে নিখোঁজ হন তিনি।

খাদিজাও প্রায় একই সময়ে আশুলিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে যান। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত পরিবার জানতে পারেনি খাদিজা আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।

ইশরাতের মাও মিরপুরের বাসা থেকে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা–নেওয়া করতেন। একমাত্র মেয়ে যেন জঙ্গিবাদেনা জড়ান সে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না তাঁর। তিনি বলেন, আকলিমা ও খাদিজাকে বাসায় আসতে মানা করেছিলেন। পরীক্ষার ফরম পূরণের কথা বলে ৫ অক্টোবর বাসা থেকে বের হন ইশরাত। গ্রেপ্তার হওয়ার পর মেয়ের খোঁজ নিতে তিনি নরসিংদীতে যাননি।