সার্ভিস চার্জের নামে চাঁদাবাজি

উত্তরা ‘বিডিআর বাজারে’ সার্ভিস চার্জের নামে টাকা আদায়ের রসিদ।  ছবি: প্রথম আলো
উত্তরা ‘বিডিআর বাজারে’ সার্ভিস চার্জের নামে টাকা আদায়ের রসিদ। ছবি: প্রথম আলো
>সার্ভিস চার্জ না দিলে বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ব্যবসায়ীদের হয়রানি। সমিতি কার্যালয়ে নিয়েও মারধর করা হয়।


উত্তরা বিডিআর বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে দৈনিক ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়। সার্ভিস চার্জের নামে বাজারের পাঁচ শতাধিক দোকান থেকে আদায় করা এই টাকার পরিমাণ মাসে ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারের বৈদ্যুতিক বিল, পানির বিলসহ অন্যান্য পরিষেবা বাবদ মাসে এত টাকা কখনো হয় না। আদায় করা টাকার অধিকাংশই যায় কয়েকজনের পকেটে। সার্ভিস চার্জ না দিলে বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হয়। সমিতি কার্যালয়ে নিয়েও মারধর করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মে মাস থেকে ‘উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রেতা-বিক্রেতা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের’ রসিদে চাঁদা তোলা শুরু হয়। তবে ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদে কয়েক দিনের মধ্যেই কৌশল বদলানো হয়। রসিদ বাদ দিয়ে তখন রেজিস্টার খাতায় টাকা আদায় শুরু হয়।

সার্ভিস চার্জের রসিদ অনুযায়ী, দৈনিক বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২৩ টাকা, জেনারেটরের জন্য ২৫, পানির বিল ৭, নিরাপত্তাকর্মীদের বেতন ২৫, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন ১০, টয়লেট খরচ ৭, অফিস খরচ ৮, অফিস স্টাফদের বেতন ২৬, বাজার উন্নয়নে ৪০ এবং অন্যান্য খরচ বাবদ ২৯—এই মোট ২০০ টাকা দিতে হয়।

ব্যবসায়ীদের দাবি, সার্ভিস চার্জের নামে যে পরিমাণ টাকা তোলা হয়, এর অর্ধেকও খরচ হয় না। অধিকাংশ টাকা যায় সমিতির নেতাদের পকেটে।

একটি লাইন থেকে পুরো বাজারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) হিসাবে দেখা যায়, বহুমুখী সমবায় সমিতির ৬৬৩১১০০০০০০১-নম্বর মিটারে জুনে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা, জুলাইতে ১ লাখ ৯৩ হাজার বিল হয়েছে। চলতি অক্টোবরের প্রথম ১১ দিনে ৬৫ হাজার টাকার মতো বিল হয়েছে। ওই মিটারে প্রতি মাসে গড়ে পৌনে দুই লাখ টাকার বেশি বিল হয় না বলেও ডেসকোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল বাবদ দৈনিক ২৩ টাকা করে পাঁচ শতাধিক দোকান থেকে মাসে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা তোলা হয়। অর্থাৎ মাসে যে পরিমাণ বিল হয়, এর দ্বিগুণ টাকা তোলা হয় বিদ্যুৎ বিল বাবদ।

বাজারটিতে ওয়াসার দুটি পানি সংযোগ আছে। দুই সংযোগেরই গ্রাহক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন। দুই সংযোগে জুলাইতে ৬৯ হাজার ৮১২ টাকা, আগস্টে ৫৬ হাজার ৮০ এবং সেপ্টেম্বরে ৪৪ হাজার ৫০৭ টাকা বিল হয়েছে। অথচ দৈনিক ৭ টাকা বাবদ এক মাসে ব্যবসায়ীদের কাছে এক লাখ টাকার বেশি আদায় করা হয় পানির বিল বাবদ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০০৭ সালে তৎকালীন বিডিআরের পরিচালনায় এই বাজার তৈরি করা হয়। সেই থেকে এটি বিডিআর বাজার নামেই পরিচিত। তবে এখন এটি সমিতির মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। গেল মে মাসের আগে সমিতির সার্ভিস চার্জ ছিল দৈনিক ১০ টাকা। আর প্রতিটি দোকানে সাব-মিটার আছে। সে অনুযায়ী বিদ্যুতের বিল দিতে হতো। ব্যবসার ধরনভেদ তখন ৩০০-৯০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল আসত। এতে একজন ব্যবসায়ীর সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুতের বিলসহ মাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকার মতো লাগত। এখন এই খরচ পাঁচ-ছয় গুণ বেড়ে গেছে।

সবজি ব্যবসায়ী আবুল হাসেম বলেন, দৈনিক ১০ টাকায় তাঁরা আগে নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, পানি, জেনারেটরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা পেতেন। তিনি বলেন, আগে মিটার অনুযায়ী মাসে ৩০০-৪০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল আসত। সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা আসত। এখন ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীরই মাসে ছয় হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।

ব্যবসায়ী মো. আলী রাজ বলেন, সাধারণ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে সার্ভিস চার্জের নামে জোর করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ, নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী—সব সমিতির নামে, তাই চাঁদা না দিয়ে উপায় নেই। তিনি বলেন, সমিতির নেতা আনোয়ার হোসেন, খালেক সরকার, আলী মাস্টার, নূর আলম, ইলিয়াস, জাহাঙ্গীর ও আকতাররা সমিতির নামে এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

যোগাযোগ করা হলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীদের মতেই সার্ভিস চার্জ দৈনিক ২০০ টাকা করা হয়েছিল। সব খরচ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। উদ্দেশ্য ছিল দোকানঘর সংস্কার। তবে ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তিন দিনের মধ্যে সার্ভিস চার্জ নেওয়া বন্ধ করা হয়। ব্যবসায়ীদের কাছে এখন কোনো টাকা নেওয়া হয় না। রেজিস্টার খাতায় লিখে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেন।

তবে সমিতির যুগ্ম সম্পাদক খালেক সরকারের দেখানো রসিদে অক্টোবরের ১০ তারিখে মাছ-মুরগির দোকান থেকে জেনারেটর ও পানি বাবদ ২০ টাকা, কাঁচাবাজার থেকে পানি বাবদ ২০ টাকা আর মুদিবাজার থেকে জেনারেটর বাবদ ৪০ টাকা করে দৈনিক ওঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে খালেক সরকার বলেন, এটা চাঁদাবাজি নয়।