বাবুল চিশতী, এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় চট্টগ্রামভিত্তিক এসএ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম ও ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ রোববার সকালে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলাটি করেন দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলায় শাহাবুদ্দিন আলমের স্ত্রী ইয়াসমিন আলম এবং ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক চার শীর্ষ কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও চৌধুরী মোশতাক আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম এম শামীম, ব্যাংকের এসভিপি জিয়া উদ্দিন আহমেদ এবং এসইভিপি ও গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, অভিযোগ অনুসন্ধানের সময় রেকর্ডপত্র ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের ১০ মে মেসার্স লায়লা বনস্পতি প্রডাক্টস লিমিটেড নামে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলেন তাঁরা। এর দুই সপ্তাহ আগে তাঁরা ৭০ কোটি টাকার কম্পোজিট লিমিটের জন্য ওই শাখায় আবেদন করেন। শাহাবুদ্দীন আলম প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন আলম চেয়ারম্যান। কোম্পানির বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যাংকটির ওই শাখায় হিসাব খোলা ও হিসাব পরিচালনা করার দায়িত্ব পান শাহাবুদ্দিন আলম। হিসাবটিতে তেমন লেনদেন না হলেও শাখা থেকে ম্যানেজার অপারেশন জিয়া উদ্দিন আহমেদ, শাখা ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন প্রস্তাবটি ২৮ মে ২০১৫ তারিখে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠান। প্রস্তাবটি ৪ জুন ব্যাংকের ১১তম জরুরি বোর্ড সভায় তড়িঘড়ি করে পাস করার চেষ্টা করা হলেও তা বাতিল হয়। পরে আবার ৬ জুলাই ৩০ কোটি টাকার কম্পোজিট লিমিটের প্রস্তাব গ্রাহকের সিআইবি ছাড়াই পাঠানো হয়। পরে ওই ঋণ প্রস্তাবটি পরিচালনা পর্ষদ ৬ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেয়। 

এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ভোজ্যতেল আমদানি, প্রক্রিয়াজাত ও সরবরাহের জন্য গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হলেও ঋণ বিতরণসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, শাখা প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনে অল্প অল্প করে প্রকল্প ভিত্তিতে ঋণ ছাড় করার কথা থাকলেও শাখার কর্মকর্তারা তা না করে মাত্র ৩টি ধাপে অল্প সময়ের মধ্যে ঋণটি বিতরণ করে দেন। এতে গ্রাহক সহজেই উত্তোলিত ঋণটি নিজের মতো করে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। শাখার মঞ্জুরিপত্রে বিদেশি ঋণপত্রের কথা বলা থাকলেও সব টাকা স্থানীয় ঋণপত্রের বিপরীতে হয়েছে। ঋণপত্র সুবিধা নিয়ে গ্রাহক আসলেই কোনো পণ্য আমদানি করেছেন কি না, তা–ও ব্যাংক যাচাই করেনি। মালামাল আমদানি হয়ে থাকলে তা থেকে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে কী করা হলো, এ বিষয়েও শাখার কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। গ্রাহক তাঁর ঋণ হিসাব থেকে ঋণসীমার ২০ কোটি টাকা তোলার পর উল্লেখযোগ্য কোনো লেনদেনও করেননি।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লায়লা বনস্পতি প্রডাক্টস লিমিটেড ব্যাংক থেকে ২৯ কোটি ৫১ লাখ ৮৫ হাজার ৮২০ টাকা আত্মসাৎ করেছে, যা সুদসহ ৩৭ কোটি ১৪ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ওই অর্থের অবৈধ প্রকৃতি গোপন করার লক্ষ্যে জ্ঞাতসারে স্থানান্তর, হস্তান্তরপূর্বক লেয়ারিং করে মানি লন্ডারিং করেছে। পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধজনকভাবে ঋণের নামে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ওই অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তরপূর্বক লেয়ারিং করার অভিযোগে মুদ্রা পাচার আইন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করা হয়েছে।

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় আরও মামলা
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় এর আগে এ বছরের ১০ এপ্রিল ও ১৬ আগস্ট দুটি মামলা করে দুদক। ১০ এপ্রিল করা মামলায় চারজনের বিরুদ্ধে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়। মামলা করার পরপরই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী), চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ব্যাংকের এসভিপি জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদুর রহমান খান।

টাঙ্গাইল মডেল থানায় ১৬ আগস্ট করা মামলায় আসামি করা হয়েছে মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, এসটুআরএস করপোরেশনের মালিক ফেরদৌস জুবায়েত ইসলাম ভূঁইয়া, ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ব্যাংকটির জামালপুরের বকশীগঞ্জ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক সাজলী শবনব এবং ব্যাংকের বগুড়া শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার ও টাঙ্গাইল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক সোহেল রানাকে। মামলার পরপরই দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফেরদৌস জুবায়েত ইসলাম ভূঁইয়াকে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অপরাধলব্ধ ৯ কোটি ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংকে নগদ জমা করে, পরে বর্ণিত অর্থের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করার লক্ষ্যে জ্ঞাতসারে স্থানান্তর এবং হস্তান্তরপূর্বক লেয়ারিং করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন।

ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটি গত বছর থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। সেই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে মাহবুবুল হক চিশতী, তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য, ব্যাংকের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে গত এপ্রিলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। ওই তালিকায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নাম ছিল না।

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে ব্যাংকটির সাবেক দুই শীর্ষ ব্যক্তির অনিয়ম তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ফারমার্স ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। পরিচালকের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তাঁরা।

অন্য মামলায় কারাগারে আছেন শাহাবুদ্দিন আলম
ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে ব্যাংক এশিয়ার করা এক মামলায় ১৭ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তার হন শাহাবুদ্দিন আলম। এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন আলম বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণ ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন। তাঁর মোট ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬২২ কোটি ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৯ টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখা থেকে তাঁর নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৭০৯ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৯৪০ কোটি ১০ লাখ ৫১ হাজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৩৬ কোটি ১১ লাখ ৪১ হাজার, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৭০১ কোটি ৪৯ লাখ ৩১ হাজার, পূবালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ২৯৭ কোটি ১১ লাখ ৪৮ হাজার, কৃষি ব্যাংকের ষোলশহর শাখা থেকে ১৭৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৭ হাজার, অগ্রণী ব্যাংক করপোরেট শাখা থেকে ৫৪৮ কোটি ৪৪ লাখ, জনতা ব্যাংক শেখ মুজিব রোড করপোরেট শাখা থেকে ১১৮ কোটি ২২ লাখ ৭১ হাজার ও প্রাইম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ৫৫ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি।

মো. শাহাবুদ্দিন আলম ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের নুরুল আমিন লাবলুর কাছ থেকে ১০ কোটি ও মেওয়া ওয়েল অ্যান্ড ফ্যাডস থেকে ২৬ কোটি ৭৭ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণও তিনি পরিশোধ করেননি।