সাড়ে ছয় বছর আগে হালিমা খুন হন: সিআইডি

ভবনের ব্যবস্থাপক শরীফ উদ্দিন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে পড়ে ছিল হালিমার লাশ। ১৪৮ / ১ কাঁঠালবাগানের ছয়তলা ভবনের সামনে থেকে ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান
ভবনের ব্যবস্থাপক শরীফ উদ্দিন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে পড়ে ছিল হালিমার লাশ। ১৪৮ / ১ কাঁঠালবাগানের ছয়তলা ভবনের সামনে থেকে ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান

মাদকাসক্ত ছেলেকে ‘ভালো’ করার আশায় বিয়ে করিয়ে আনা হয় দরিদ্র পরিবারের হালিমাকে। ছেলে তো সুস্থ হনইনি, বরং ঘটনার বলি হতে হয়েছে হালিমাকে। পরিবার থেকে টাকা এনে দেওয়ার চাপ দিয়ে নির্যাতন করা হতো হালিমাকে। ঘটনার দিন নির্যাতন করে হত্যার পর হালিমার লাশ ভবনের নিচে ফেলে রেখে তা আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়।

সাড়ে ছয় বছর আগে হালিমার মৃত্যু নিয়ে নতুন প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। হত্যার ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে হালিমার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধ।

হালিমার স্বামী সাইফুল ইসলাম (৩০), শ্বশুর নজরুল ইসলাম (৬৫) ও শাশুড়ি কুলসুম বেগমের (৫০) বিরুদ্ধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। সাইফুল কারাগারে, অন্যরা জামিনে মুক্ত। হালিমার লাশ পাওয়া যায় কাঁঠালবাগান এলাকায় শ্বশুরবাড়ির সামনের রাস্তায়।

ঢাকার আদালতে দেওয়া সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২২ বছর বয়সী হালিমা খাতুনকে ২০১২ সালের ৩ মার্চ বাসার চারতলার একটি কক্ষে হত্যা করে লাশ বাসার নিচে রেখে দেন সন্দেহভাজন খুনি—স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি।

দুই বছর আগে অবশ্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, হালিমা খুন হননি। ছয়তলা থেকে লাফ দিয়ে সেদিন আত্মহত্যা করেন তিনি। হালিমার মৃত্যুর ঘটনায় সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে স্বামী সাইফুল ও শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধ অভিযোগ আনা হয়েছে। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে হালিমার পরিবার নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হালিমা ছয়তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল, এর সত্যতা তিনি পাননি। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, সেদিন হালিমার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি মিলে তাঁকে হত্যা করে লাশ ভবনের নিচে ফেলে রেখে দেন।

হালিমা খুন হন
খুন হওয়ার দেড় বছর আগে ২০১০ সালে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে হালিমার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়।

মামলার বাদী হালিমার মা আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ে পবিত্র কোরআনে হাফেজ। বিয়ের পর জানতে পারেন, সাইফুল মাদকাসক্ত। প্রায়ই বাইরে থেকে মাদক সেবন করে বাসায় ফিরে হালিমাকে মারধর করতেন সাইফুল।

আদালতে দেওয়া সিআইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাদকাসক্ত হওয়ায় সাইফুলকে ‘ভালো’ করার আশায় তাঁর বাবা-মা গরিব পরিবারের মেয়ে ধার্মিক হালিমার সঙ্গে বিয়ে দেন। সাইফুলের মাদকাসক্তির বিষয়টি হালিমার পরিবারকে জানানো হয়নি। বিয়ের পর শ্বশুর নজরুল আর শাশুড়ি কুলসুম হালিমাকে বাসা থেকে বের হতে দিতেন না। প্রায়ই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সাইফুল হালিমাকে মারধর করতেন। আশপাশের লোকজন হালিমার কান্নাকাটির আওয়াজ পেত। মারধরের প্রতিকার চেয়ে কথা বলতে গেলে হালিমার শ্বশুর–শাশুড়ি নানাভাবে তাঁকে অত্যাচার করতেন।

কাঁঠালবাগান এলাকায় আসামি সাইফুলদের বাসার সামনের ছোট্ট সরু গলিতে পড়েছিল হালিমার লাশ। ছবি: আসাদুজ্জামান
কাঁঠালবাগান এলাকায় আসামি সাইফুলদের বাসার সামনের ছোট্ট সরু গলিতে পড়েছিল হালিমার লাশ। ছবি: আসাদুজ্জামান

অভিযোগপত্রে বলা হয়, হালিমাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তাঁর কোলে ছিল সাত মাস বয়সী পুত্রসন্তান। হালিমাকে তাঁর বাবার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আনার জন্য নির্যাতন করতেন আসামিরা। ঘটনার দিন রাতে বাসায় সাইফুল, নজরুল ও কুলসুম হালিমাকে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ রাস্তায় ফেলে রাখেন।

ওই ভবনের ব্যবস্থাপক শরীফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ছয়তলা ভবনের চারতলা ও ছয়তলার মালিক সাইফুলের বাবা নজরুল ইসলাম। হালিমাকে নিয়ে চারতলায় থাকতেন সাইফুল। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, হালিমার লাশ বাসার সামনে আড়াআড়ি করে শোয়ানো।

কাঁঠালবাগানের বাসায় সরেজমিনে দেখা যায়, ছয়তলার বাসার সামনে পাঁচ হাতের মতো জায়গা ফাঁকা।

হালিমার মা আমেনা বলেন, ছয়তলা থেকে কেউ পড়লে মাথাসহ শরীরের অনেক কিছুই ভেঙে যাওয়ার কথা, হালিমার তা হয়নি।

বাড়ির ব্যবস্থাপক শরীফ উদ্দিন বলেন, সেদিন হালিমার হাত-পা তিনি ভাঙা দেখেননি।

হালিমার মা বললেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। সাইফুলরা বড়লোক। আমি কি আমার নিষ্পাপ মেয়ের খুনের বিচার পাব না? আমি সাইফুলদের ফাঁসি চাই।’