লিমনের কষ্টের দায়ভার

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

কিছুদিন আগে লিমন এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি সামনে যেতেই উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা চেক বের করে মেলে ধরল। চেকটা ওর জীবনের প্রথম উপার্জনের। ওর দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম বলে প্রথম উপার্জনের সংবাদটা আমাকে দিতে এসেছিল। একটা সংবেদনশীল, কিন্তু কঠিন সংগ্রামী মনের ছেলে লিমন।

র‍্যাব গুলি করে লিমনের পা ভেঙে দিয়ে থেমে থাকেনি, নানা হুমকি আর মামলা দিয়ে তার জীবন বিপর্যস্ত করে দিতে চেয়েছে। লিমনের মা আর লিমন মিলে সেই বিপদ সামলেছে। আজ লিমন নিজেকে একজন উপার্জনকারী নাগরিক হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। আমার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠেছিল। সে সময় মাত্র এসএসসি পাঠরত নির্যাতিত ছেলেটি আজ একজন পেশাজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চলেছে। আমার পেশাগত জীবনের এই সুখটুকুর রেশ কাটতে না–কাটতেই পত্রিকায় দেখতে হলো লিমনের হাত ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকা ছবি—কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং দুর্বৃত্তদের আক্রমণে আহত হওয়ার কারণে!

বিষয় হলো, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হঠাৎ জমি দখল আর নানা অপরাধের অভিযোগ তোলামাত্রই বিভিন্ন লোক দল বেঁধে দফায় দফায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে; যথারীতি পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকছে। একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেলে ঢুকে আক্রমণ চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় কোনো বিবেকবান, কর্তব্যসচেতন মানুষ চুপ করে থাকতে পারে না। অকুস্থলে উপস্থিত লিমনও পারেনি। লিমন সেই আক্রমণের প্রতিবাদ করে ও সেটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। পা হারানো লিমন তাই এখন ভাঙা হাত নিয়ে চিকিৎসাধীন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘হঠাৎ’ বললাম এ কারণে যে, কেন্দ্রটি ইদানীং প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই প্রতিষ্ঠান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জগতে অত্যন্ত প্রশংসার সঙ্গে দরিদ্র জনমানুষকে নানা সেবা প্রদান করে আসছে। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই অঙ্গনে যে অবদান, তা–ও সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত। প্রায় অর্ধশতক ধরে চলা এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যদি এত অন্যায় আর বেআইনি কাজের অভিযোগ থাকে, তাহলে আমাদের জানমালের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নজরে এল না কেন?

আজ যখন আমাদের ভয়ানক প্রতিহিংসাপ্রবণ রাজনীতিতে জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাজনৈতিকভাবে একটা অবস্থান নিয়েছেন, যা স্পষ্টতই সরকারবিরোধী, তখনই কেন্দ্র ও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যত অপরাধ চিহ্নিত হতে থাকল এবং তার প্রতিকারের দায়িত্ব নিয়ে দেশের সব আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কিছু লোক এখতিয়ার–বহির্ভূত ও প্রতিকারহীনভাবে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকল। তাদের দাবি সংগত হলে সবচেয়ে সহজ ও উচিত পথ তো ছিল আইনের আশ্রয় নেওয়া, বেআইনি দুর্বৃত্তপনা করা নয়। সরকার আর সংশ্লিষ্ট সরকারি বাহিনীগুলোর দায়িত্ব কি ছিল না তাদের সেই কথা মনে করিয়ে দেওয়া? তারা সেটা করেনি কেন? সেই দায়িত্ব যদি যথাযথভাবে পালিত হতো, তাহলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে অন্যায়ভাবে পা হারানো লিমনকে আরেকবার হাত ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকতে হতো না। লিমনের এই কষ্টের দায়ভার কে নেবে?

 আরও পড়ুন...