চার দিন পরও পুলিশ নীরব

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই জায়গাটি দখল করে তোলা দেয়াল।  ছবি: প্রথম আলো
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই জায়গাটি দখল করে তোলা দেয়াল। ছবি: প্রথম আলো

শতাধিক যুবককে রড, লাঠি আর চাপাতি নিয়ে ছুটে আসতে দেখে একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন শিরিন আক্তার। দুর্বৃত্তরা দরজা ভেঙে সেখানে ঢোকে। এরপর চুলের মুঠি ধরে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে। হাত–পা ছুড়ে যুবকদের হাত থেকে কোনোমতে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচেন এই নারী।

শিরিন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র পিএইচএ ভবনের আবাসিক তত্ত্বাবধায়ক। গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে শিরিন বলছিলেন, ‘শুক্রবার দৌড়ে যখন পালিয়ে যাই, তখন ওড়না ওদের হাতে রয়ে যায়।’

শুধু শিরিনই নন, ওই দিন দুর্বৃত্তদের হাতে লাঞ্ছিত হন ইলেকট্রিশিয়ান মো. সবুজ আলম ও প্রকৌশলী আতিকুর রহমান। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয় গণবিশ্ববিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পড়ুয়া মেয়েদের। যাঁরা হোস্টেলে থাকতেন তাঁদের কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অভিযোগ, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ‘কটন টেক্সটাইল ক্রাফটস লিমিটেড’–এর মালিক কাজী মহিবুর রবের নির্দেশে দুর্বৃত্তরা এ হামলা চালায়। প্রাথমিক হিসাবে ৮৬ লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট হয়েছে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পুরো জায়গাটি প্রায় ৬২ একর। এর এক–তৃতীয়াংশ জায়গা নিজের দাবি করেছেন কটন টেক্সটাইল ক্রাফটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান কাজী মহিবুর রব। মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। একবার ফোন ধরে কয়েক সেকেন্ড পর ফোন কেটে দেন।

আশুলিয়া থানায় করা মামলায় কাজী মহিবুর ১৯ দশমিক ৬৩ একর জমির ক্রয়সূত্রে মালিক হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। পুরো জায়গাটি গণস্বাস্থ্যের দখলে থাকলেও তিনি মামলায় নিজেকে ভোগদখলকারী বলে উল্লেখ করেছেন।

হামলার পর চার দিন পার হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, আশুলিয়া থানায় দুটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। মামলা নেওয়া দূরে থাক, পুলিশের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেননি।

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি যে জায়গার ওপর রয়েছে, তার একটি অংশ কটন টেক্সটাইল ক্রাফটস লিমিটেড তাদের বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

লুটপাট, ভাঙচুরের বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এমন কিছুর সত্যতা আমি পাই নাই। পুলিশ কর্মকর্তা পাঠানো হয়েছিল, তাদের প্রতিবেদন বলেছে, এটি আসলে তাদের আগের বিরোধের জের ধরে ঘটনাটি ঘটেছে।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মামলা না নেওয়ার বিষয়ে ওসি রিজাউল হক বলেন, ‘কেউ হঠাৎ করে মামলা নিয়ে এলে সেটি তো আর নেওয়া যায় না। তাঁরা অভিযোগ দিয়েছেন, আমরা নিয়েছি। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে অবহিত আছেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।’

পুলিশ ঘটনা নিয়ে সন্দিহান হলেও গতকালও পিএইচএ ভবনে গিয়ে ভাঙচুরের আলামত দেখা যায়। ভবনের প্রবেশমুখেই দুটো কক্ষের দরজা ও জানালার কাচের টুকরো ভেঙে নিচে পড়ে ছিল। দেয়াল থেকে ঝুলছিল সিসি ক্যামেরার তারগুলো।

>সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মো. নাছির উদ্দিনের নেতৃত্বে পিএইচএ ভবনের প্রবেশপথের মুখে দেয়াল নির্মাণকাজ অব্যাহত রয়েছে।

দখল অব্যাহত

মূল সড়ক থেকে পিএইএ ভবনে যাওয়ার প্রবেশপথের মুখে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন দখলের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকেরা সেখানে দেয়াল নির্মাণ করছেন। স্থাপন করা সাইনবোর্ডে নাছির ছাড়াও তাঁর ভাই মো. আবু বকর সোহেলের নাম রয়েছে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে বিতর্ক সুযোগ হিসেবে দেখছে কিছু লোক। তাঁদের এই কথার সত্যতা মেলে আওয়ামী লীগের নেতা নাছির উদ্দিনের কথায়ও।

জায়গা যদি আপনারই হয়ে থাকে, তাহলে এত দিন কেন দখলে নেননি—এমন প্রশ্নের জবাবে নাছির বলেন, ‘আমি সুযোগের সন্ধানে ছিলাম। এখন মনে হয়েছে দখল নেওয়া সম্ভব, তাই কাজ শুরু করেছি।’

সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় আলোচিত–সমালোচিত হন মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে মাছ, ফল চুরিসহ জমি দখলের অভিযোগে আশুলিয়া থানায় পাঁচটি মামলা করা হয়। এর কিছুদিনের মাথায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুর হয়।

পিএইচএ ভবনের পরিচালক অনীল কুমার ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন থেকেই তাঁরা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে না। তিনি বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এর প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী হলেও পাঁচজনের একটি ট্রাস্টি বোর্ড এটি পরিচালনা করে। তাই কারও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঘিরে অনিয়শ্চয়তা

আগামী ১৫ থেকে ১৯ নভেম্বর জনস্বাস্থ্য নিয়ে পিএইচএ ভবনে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। ১০৭টি দেশের ৬০০ প্রতিনিধি এতে অংশ নেবেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই সম্মেলন নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে আয়োজকদের।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি নাজিম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁদের ভিসা ও প্লেনের টিকিট কেটে ফেলেছেন। এ–সংক্রান্ত অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও শেষ। এই পরিস্থিতিতে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। একমাত্র সরকার বন্ধ না করলে সব বাধা ডিঙিয়ে তাঁরা সম্মেলন করবেন।