তিন বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টকে আশ্বস্ত করবে আ.লীগ

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি নাকচ করা হচ্ছিল। এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ আহ্বানের পরদিনই সাড়া দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক ধারা ও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সংলাপে সাড়া দেওয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, সংলাপে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার, সভা–সমাবেশ করার সুযোগ দেওয়া ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার না করার ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্টকে আশ্বস্ত করা হবে। এমনকি ভোটের সময় আইন অনুযায়ী সেনা মোতায়েনের ব্যাপারেও ঐক্যফ্রন্টকে আশ্বস্ত করা হবে। তবে সংবিধান সংশোধন করতে হবে—এমন দাবি আওয়ামী লীগ মানবে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় সেভাবে প্রাধান্য পাবে না বলেই বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

তবে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে এরা সাত দফা দিচ্ছে। কিন্তু দাবি আদায়ে সরকারকে চাপে ফেলতে ঐক্যফ্রন্ট কার্যকর কোনো কর্মসূচিতে যায়নি। এরা যা চাইছে, তা পূরণে কতটা আশাবাদী, ঐক্যফ্রন্টের কর্মকাণ্ডে তা মোটেও দৃশ্যমান নয়। এ কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংলাপে বসতে চেয়ে চিঠি দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ মনে করেছে, সংলাপে বসলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে। বিশেষ করে দাবিগুলোর ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্ট কতটুকু ছাড় দেবে, দাবি না মানলে তারা নির্বাচনে আসবে কি না, এই মনোভাবগুলো স্পষ্ট হবে। এ বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে জরুরি হবে।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে বসতে চাওয়ার আহ্বান গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের তথা সরকারের প্রজ্ঞা সব মহলে আলোচিত হচ্ছে। সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী সংলাপ প্রস্তাব এবং সেটি বিএনপি প্রত্যাখ্যান করায় আওয়ামী লীগ এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। অনেকটা একতরফা নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগ পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে সেটিও একটা কারণ হয়েছিল। এবার সংলাপে আসছে ঐক্যফ্রন্ট। তাদের কাছে ক্ষমতাসী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারলে, কিছু দাবির ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারলে, তা তাদের জন্য ভালোই হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলছেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেদিন চিঠি দিয়েছে, সেদিন শেখ হাসিনা বলেছেন, ওরা (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) কী বলতে চায়, আমি শুনি। নেত্রী একটু অন্যভাবে দেখতে চাইছেন ঘটনাকে এবং ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও বলেছেন যে রাজনীতিতে অন্য যেকোনো নেতার চেয়ে শেখ হাসিনা প্রজ্ঞায় অনেক ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) প্রমাণ করলেন, টেবিলে সমাধানের পথ ঐক্যফ্রন্ট খুঁজে পাবে।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মোটামুটি নিরপেক্ষভাবে সংলাপের বিষয়ে কথা বলা হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত চিঠিতে ‘সংবিধানসম্মত’ সব বিষয়ে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের দিন থেকে তারা সাত দফা ও ১১টি লক্ষ্যের কথা বলছে। ইতিমধ্যে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের সমাবেশে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে তাদের দাবিগুলোর বিষয় মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের দুজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সংলাপ হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা জামায়াতের কারও সঙ্গে না। নির্বাচন সামনে রেখে সংলাপ করা একটি গণতান্ত্রিক পথ, সে পথ বেছে নেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবে কোনো চাপ নয়। আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, এ কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের বিষয়ে এত দ্রুত সাড়া দেওয়া হয়েছে। তবে সংলাপে সংবিধানের বাইরে কোনো কথা বলা বা কোনো অনুরোধ গ্রহণ করা হবে না। সংবিধানের মধ্যে থেকে যেসব বিষয়ে কথা বলা যায়, শুধু তা-ই আলোচনা করা যেতে পারে।

দলের অপর একটি সূত্র বলছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি, দেশের স্বার্থে সংলাপে বসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। এর আগেও এমন উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগই। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপে বসার বিষয়টি নাকচ করা হয়েছিল। এবার সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়ে বড় একটি কারণ হলো, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ হচ্ছে না, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ হচ্ছে। যেখানে সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিষয়ে একমত। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের চিঠির ভাষা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যে ভাষায় চিঠি লেখা হয়েছে, সে বিষয়টি আওয়ামী লীগের দৃষ্টি এড়ায়নি।

বিএনপি কারাবন্দী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ইভিএম ব্যবহার না করাসহ সাত দফা দাবি আছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিতব্য সংলাপে এসব বিষয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। কারণ হিসেবে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন আদালতের রায়ের মাধ্যমে, তিনি কোনো রাজবন্দী নন। এ ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য দাবিগুলোও সংবিধানসম্মত নয়, এ কারণে এসব বিষয়ে বিএনপি কথা বললেও আওয়ামী লীগের করার কিছু নেই।

সংলাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় পলিটিকস অব কনসাল্টেশন অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশনে বিশ্বাস করি বিধায় প্রধানমন্ত্রী আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রেখে তাদের (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) চিঠিতে সাড়া দিয়েছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো কিছু খুঁজে বের করা, কোনো সমাধান করা সম্ভব নয়।

শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সকলের অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি অর্থবহ সংলাপ আহ্বান করে চিঠি দেয় ২৮ অক্টোবর। এর পরদিন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের বিষয়ে সাড়া দেন, যে বিষয়টি সংবাদ সম্মেলন করে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর কন্যার দরজা কারও জন্য বন্ধ থাকে না। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, আমরা সংলাপে বসতে রাজি।’

যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েক মাস ধরে কোনো দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে আসছিলেন। তিনি বলেছেন, দেশে এমন কোনো অবস্থা নেই যে কোনো দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে। সংলাপের বসার বিষয়ে তাঁর ধারাবাহিক অস্বীকৃতির মধ্যেই দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সংলাপে বসার জন্য আজ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের বাসায় চিঠি নিয়ে দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপকে পাঠান। এই চিঠি অনুযায়ী আগামী ১ নভেম্বর সন্ধ্যায় সংলাপের জন্য গণভবনে যাবেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।