আস্থার সংকট নিয়ে ভোটের পথে ইসি

শুরু হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা। কিন্তু এখনো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর অংশীজনদের একটি বড় অংশের আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তফসিলের আগে আগে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে ইসির তোড়জোড় রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে।

সংবিধান অনুযায়ী দশম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে একাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৮ জানুয়ারি। তাহলে আজ ৩১ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে।

এদিকে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আজ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইসির বৈঠক করার কথা রয়েছে। কাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি তুলে ধরবে ইসি। এরপর আগামী সপ্তাহে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে তফসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। ৪ বা ৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করে ১৮ থেকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

তফসিল প্রস্তুতির পাশাপাশি ইসির তোড়জোড় ইভিএম ঘিরে। এখনো আইনের সংশোধন না হলেও আগামী নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান যোগ করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি আইনে পরিণত করা হবে।

অন্যদিকে দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রথম দফায় বেশ কিছু ইভিএম কেনার কাজও চলছে। প্রথম ধাপে ৭৫ হাজার ইভিএম কেনা হতে পারে। ২৭ অক্টোবর দেশের আটটি শহরে ইভিএম প্রদর্শনী করে ইসি। নভেম্বরে রাজধানীতেও ইভিএম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

গত বছর ইসির সংলাপে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছিল নির্বাচনে সেনা মোতায়েন এবং ইভিএম ব্যবহার করা না–করা। বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ৭টি দল ইভিএমের পক্ষে ছিল।

কাল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই সংলাপের দিকেও নজর রাখছে ইসি। এ–সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সংলাপে রাজনৈতিক কোনো সমঝোতা হলে কমিশন সংবিধান ও আইনের মধ্যে থেকে তা সমন্বয়ের চেষ্টা করবে।

নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ এবং কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে প্রশংসিত হয়েছিল ইসি। কিন্তু পরে সংলাপের সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ না নেওয়া এবং পাঁচ সিটি নির্বাচনে ইসির অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড মানুষের মনে সন্দেহ বাড়িয়েছে।

এ অবস্থায় নির্বাচনের আগমুহূর্তে ইসি পুনর্গঠনের দাবি জোরালো হচ্ছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোট এবং বাম গণতান্ত্রিক জোট আনুষ্ঠানিকভাবে ইসি পুনর্গঠনের দাবি করেছে। এই তিনটি জোটে ৩১টি দল আছে। এর মধ্যে ১৩টি দল ইসিতে নিবন্ধিত। এর বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বিকল্প ধারাও ইসি পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দলের বিষয় আলাদা। অংশীজনদের একটি বড় অংশের আস্থা ইসি অর্জন করতে পারেনি। দৃশ্যত বর্তমান কমিশন স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি। কেন পারেনি, সেটা তারা ভালো জানে। ভবিষ্যতে পারবে, এমন লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। অল্প সময়ে নতুন ইসি গঠন করলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে না। এই ইসি দিয়ে নির্বাচন সম্ভব হবে না—এটাও ঠিক না। সরকার যদি আসলেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়, তাহলে তা সম্ভব।

তবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম মনে করেন, ইসি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের অনেক চাওয়া–পাওয়া, দাবি থাকতে পারে। কিন্তু ইসির সীমাবদ্ধতা আছে। আইন ও সংবিধানের বাইরে কিছু করার এখতিয়ার ইসির নেই। আস্থার সংকট ও বর্তমান কমিশন পুনর্গঠনের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, বক্তব্য দেওয়ার স্বাধীনতা সবার আছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করার অবকাশ তাঁর নেই।

নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি, আচরণবিধি প্রতিপালনে পদক্ষেপ নেওয়া, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতেও ইসি নিজেদের শক্তির জানান দিতে পারেনি। ৫ সিটি নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় জাল ভোট, প্রকাশ্যে সিল মারা, ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা, বিরোধীপক্ষের এজেন্ট তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনে ইসিকে ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও সিটি নির্বাচনগুলোতে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেভাবে আচরণ করার কথা, ইসি সেটা করতে পারছে না বা করছে না। ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটার পর একটা বিতর্কে জড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই কমিশন আস্থা অর্জন করতে পারেনি।