কংক্রিটের নগরীতে ছাতিমের সৌরভ

হেমন্তে ছাতিমের শাখা ভরে গেছে ফুলে ফুলে। সম্প্রতি বোটানিক্যাল গার্ডেনে।  ছবি: প্রথম আলো
হেমন্তে ছাতিমের শাখা ভরে গেছে ফুলে ফুলে। সম্প্রতি বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ছবি: প্রথম আলো

একটু আগেভাগেই সন্ধ্যা নামে মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। তখনো পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্য লাল–কমলা মিশেলের আলো ছড়াচ্ছে। গাছের পাতার ফাঁক গলে সেই আভা এসে মাটি স্পর্শ করছে। এমন আবহে উদ্যানের নার্সারির পাশ দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ নাকে এসে মিষ্টি ঘ্রাণের ঝাপটা লাগে।

মুহূর্তেই জার্মান লেখক প্যাট্রিক সাসকিন্ডের পারফিউম বইটির কথা মনে পড়ে। পারফিউম বানাতে জঁ বাপ্তিস্তে গ্রেনোউলে নামের অতিমানবীয় ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন যুবকের নৃশংসতা ভেবে গায়ে কাঁটা দেয়। তবে ঘোর কেটে কার্তিকের মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভেসে আসা সেই মিষ্টি ঘ্রাণের উৎস খুঁজে পেতে দেরি হয়নি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখের সামনে ঘিয়ে রঙা থোকা থোকা ফুল। ছাতিম। কংক্রিটের নগরবাসীর হৈমন্তিক আবেগের অন্যতম উৎস।

ছাতিম লম্বা ছাতা আকৃতির গাছ। শাখার শীর্ষে ছোট ছোট ফুল চোখে আবেশ ছড়ায়। তবে দৃষ্টিসীমার চেয়ে খানিকটা উঁচু বলে ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করতে কিছুটা সতর্ক দৃষ্টি বোলাতে হয়। গুচ্ছাকৃতির প্রতিটি ফুলে পাঁচটি পাপড়ি সন্নিবেশিত থাকে, নিচের অংশ নলের মতো। শেষ বিকেল থেকে সকাল পর্যন্ত ফুলের রেণু সৌরভ ছড়ায়। প্রতিটি ফুলের গুচ্ছকে ঘিরে থাকে সাতটি গাঢ় সবুজ রঙের পাতা। যে কারণে গাছটিকে সংস্কৃত ভাষায় ‘সপ্তপর্ণ’ বা ‘সপ্তপর্ণা’ নামেও ডাকা হয়। লম্বাটে গড়নের পাতাগুলো স্তরে স্তরে সাজানো। ছাতিম পাতার ওপরের দিক মসৃণ ও চকচকে। নিচের দিক ধূসর।

ফুলের সৌন্দর্য যত না মুগ্ধ করে, সৌরভ তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ফুলের সৌন্দর্য ও ঘ্রাণে মোহাবিষ্ট হয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধতায় কেটে যায়।

ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ফুলের দিকে তাক করতেই কয়েকজন দর্শনার্থী এসে হাজির। কেউ ঘাড় কাত করে, কেউ থুতনি উঁচু করে ফুল দেখতে দেখতে ছাতিম নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসেন। দর্শনার্থী আরিফা নাজনীন বলেন, তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে বেশ কয়েকটি ছাতিমগাছ ছিল। জ্যোৎস্নার রাতে চাচাতো ভাই–বোনেরা মিলে ছাতিম ফুল দেখতে বের হতেন। শিশিরভেজা চাঁদের আলোয় ছাতিম ফুলের সৌন্দর্য অনন্যসাধারণ। বাবার বকা না খাওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরতেন না।

তাঁর কথা শেষ না হতেই আরেক দর্শনার্থী কাজী রুহি বলেন, ছোটবেলায় ছাতিমগাছে ভূত থাকে বলে মা তাঁকে ঘুম পাড়াতেন, খাবার খাওয়াতেন। তবে বড় হয়ে তিনি ছাতিম ফুলের রূপে–ঘ্রাণে বহুবার আবিষ্ট হয়েছেন।

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ছাতিম ফুল ফুটতে শুরু করে। নভেম্বর পর্যন্ত ফোটে। এ সময় ফুল ফোটে বলে ছাতিমকে অনেকে হেমন্তের উপহার বলে থাকেন। শিশিরভেজা সন্ধ্যায় ছাতিমের ম–ম গন্ধ কঠিন হৃদয়ের মানুষের মনে দোলা দেবে বলে মন্তব্য চাকরিজীবী রাজিব হোসেনের। বিয়ের পর প্রথম হেমন্তেই তিনি স্ত্রীকে ছাতিম ফুল দেখিয়েছিলেন বলে হেসে ফেলেন।

ভারত, মিয়ানমার, চীনসহ ভারতীয় উপমহাদেশ হচ্ছে ছাতিম তরুর আদি নিবাস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও মাতামাতি শুরু হয়েছে। কেউ ছবি দিচ্ছে, কেউবা তার সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে দারুণ ক্যাপশন। সায়মা সুলতানা নামের এক শিক্ষার্থী ছাতিম ফুল নিয়ে তাঁর ভালো লাগা প্রকাশ করে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে মন্তব্যে মন্তব্যে তাঁর বন্ধুরা ছাতিম ফুল নিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার কথা লেখেন। কেউ কেউ আগামী পূর্ণিমায় ছাতিম তলে আড্ডা জমানোর প্রস্তাবও দিয়েছেন।

একসময় দেশের সর্বত্রই ছাতিমের দেখা মিলত। তবে ছাতিমের ফল খাওয়া যায় না বলে এবং কাঠের অর্থমূল্য কম হওয়ায় ধীরে ধীরে ছাতিমের কদর কমেছে, সঙ্গে ছাতিমের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছে বলে জানান জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক মোল্যা রেজাউল করিম।

ভেষজ গুণসম্পন্ন ছাতিমগাছ ৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ছাতিমের কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড এবং কাঠপেনসিল তৈরির উপকরণ মেলে বলেই এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ alstonia scholaris হয়েছে বলে প্রচলিত আছে।

নগরীর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ১০–১২টি ছাতিমগাছ রয়েছে। এর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার চত্বর, চামেরি হাউস, চ্যানেল আই প্রাঙ্গণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, জাতীয় তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণে গেলে ছাতিমের দেখা মিলবে। তবে ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা হতে কোনো জ্যোৎস্নাভেজা রাতেই আপনাকে ছাতিমতলে হাজির হতে হয়।