অসংগতিতে ভরা মামলা দিয়েই দখলের চেষ্টা

আশুলিয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুরের পর পিএইচএ ভবনে।  ফাইল ছবি
আশুলিয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুরের পর পিএইচএ ভবনে। ফাইল ছবি
>

*গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৫
*মামলার প্রধান আসামি জাফরুল্লাহ চৌধুরী
*অনুসন্ধানে তিন মামলায় নানা অসংগতি
*জাল দলিলে তিনজন জায়গা দখল করছেন

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা ৪ একর ২৪ শতাংশ জায়গা নিজের দাবি করে দেয়াল তুলছেন মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তি। এর আগে আশুলিয়া থানায় করা এক মামলায় তাঁর এই জায়গা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অবৈধভাবে দখলের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ আনেন তিনি। আশুলিয়া থানার পুলিশ বলেছে, অভিযোগটি তদন্তের পর সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় তারা মামলাটি নিয়েছে।

মোহাম্মদ আলীর এই দাবি এবং আশুলিয়া থানার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জাল দলিল দিয়ে মোহাম্মদ আলীসহ তিনজন জায়গাটি দখল করছেন। ৪ একর ২৪ শতাংশের মধ্যে ২ একর ৬৪ শতাংশ জমির দাবিদার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। আর বাকি ১ একর ৬০ শতাংশের দাবিদার আওলাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এই দুই পক্ষের সঙ্গেই উচ্চ আদালতে মোহাম্মদ আলীর একাধিক মামলা চলছে।

শুধু এই মোহাম্মদ আলী নয়, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা জায়গা নিজেদের দাবি করে গত ১৫ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত আশুলিয়া থানায় আরও চারটি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলায়ই প্রধান আসামি করা হয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে। প্রত্যেকে দাবি করেছেন, জায়গাগুলো তাঁদের দখলে ছিল। দেয়ালসহ অন্যান্য নির্মাণকাজ করতে গেলে জাফরুল্লাহর নির্দেশে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। তিনজনেরই দাবি, নিজেদের জায়গা ভোগদখল করতে দেওয়ার বিনিময়ে তাঁদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চাওয়া হয়েছে। এর একটি মামলা নেওয়া হয় ছয় বছর আগের ঘটনায়।

মামলাগুলো করেই গত শুক্রবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র পিএইচএ ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাঞ্ছিত এবং ছাত্রী হোস্টেল থেকে মেয়েদের বের করে দেওয়া হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অভিযোগ, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে কটন টেক্সটাইল ক্র্যাফটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান কাজী মহিবুর রবের নির্দেশে দুর্বৃত্তরা এ হামলা চালায়। মহিবুর রবও আশুলিয়া থানায় করা পাঁচটি মামলার একটির বাদী।

মামলাগুলোর বিষয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি মামলাই শক্ত প্রমাণাদির ভিত্তিতে করা হয়েছে। তাঁদের দলিল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি দলিল একজন করে উপপরিদর্শককে (এসআই) দেওয়া হয়েছে। ১০-১২ দিন ধরে তদন্ত করে তাঁরা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিষয়টি বিস্তারিত জানিয়েছেন। তারপরই মামলা নেওয়া হয়েছে।

তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি। পাঁচটি মামলার তিনটি মামলার খোঁজ নেওয়া হয়। এর প্রতিটিতেই অসংগতি পাওয়া গেছে।

মোহাম্মদ আলীর জাল দলিল
মোহাম্মদ আলীর দলিলে উল্লেখ আছে, তিনিসহ মোট তিনজন ২০০৩ সালে আবুল খায়ের নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গাটি কেনেন। এই আবুল খায়ের মানিকগঞ্জের হরিরামপুর সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে ৪৩১২ নম্বর দলিলমূলে দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ৮৩ শতাংশ এবং ১৯৬৭ সালের ৬৮৪৫ দলিলমূলে সাত ব্যক্তির কাছ থেকে ৪ একর ২৪ শতাংশ জায়গা কিনেছিলেন।

মোহাম্মদ আলীর এই দলিলের সত্যতা জানতে চেয়ে সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সানজিদা ইয়াছমিন ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই মানিকগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এর উত্তরে জানানো হয় যে আবুল খায়েরের ৪৩১২ দলিলে উল্লেখিত ক্রেতা-বিক্রেতার নামের সঙ্গে মূল দলিলের ক্রেতা-বিক্রেতার নামের মিল নেই। এ ছাড়া দলিলে উল্লেখিত জমির অবস্থান সাভারে নয়, মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে। আর ৬৮৪৫ নম্বর দলিলের কোনো তথ্যই মানিকগঞ্জে নেই। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মোহাম্মদ আলীর দলিলে তথ্যের এই গরমিলের কারণে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস পাঁচ বছর এই জায়গার কোনো খাজনা নেননি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, মোহাম্মদ আলীর দাবি করা এই জায়গার মধ্যে ২ একর ৬৪ শতাংশ জায়গা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কেনা। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ জায়গা ১৯৯৯ সালের ১০ মার্চ বেগম গুলশান আনোয়ার চৌধুরীর কাছ থেকে এবং ১ একর ৬৫ শতাংশ জায়গা একটি ব্যাংকের কাছ থেকে কেনা। আর জমির মালিকানা নিয়ে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে।

বাকি ১ একর ৬০ শতাংশ জমির দাবিদার আওলাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মোহাম্মদ আলী জাল দলিল বানিয়ে পুরো ৪ একর ২৪ শতাংশ জায়গা নিজের বলে দাবি করছেন। এর বিরুদ্ধে তিনি ঢাকা দ্বিতীয় যুগ্ম জজ আদালতে মামলা করেছেন। মামলাটি চলমান।

জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী জাল দলিলের বিষয়ে বলেন, দলিল জালিয়াতি করে তিনি কোনো জায়গা কেনেননি। আর নিয়মিত জমির খাজনা দিয়ে যাচ্ছেন।

অস্তিত্ব নেই কটন টেক্সটাইলের
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ ভবনসহ আশপাশের ১৯ একর ৬৩ শতাংশ জায়গা নিজেদের বলে দাবি করে কটন টেক্সটাইল ক্র্যাফটের চেয়ারম্যান কাজী মহিবুর রব গত ২৪ অক্টোবর আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। মামলায় ঠিকানা ৩১১ এলিফ্যান্ট রোড বলে উল্লেখ রয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, জায়গাটি ক্রয়সূত্রে মালিক হয়ে তাঁরা ভোগদখলে আছেন।

মামলায় উল্লেখিত ঠিকানা ধরে গত সোমবার এলিফ্যান্ট রোডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আটতলা একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন রয়েছে। ১৬টি পরিবার সেখানে থাকে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আবদুল আলিম বলেন, এখানে সব ফ্ল্যাটে পরিবার থাকে। কোনো কার্যালয় নেই। কাজী মহিবুর রব নামেও কেউ থাকেন না বলে তিনি জানান।

জায়গার বিষয়ে আবদুস সালাম বলেন, কটন টেক্সটাইল লিমিটেড যে জায়গা দাবি করেছে, সেখানে ১৯৯০-৯২ সালের মধ্যে ১১টি দলিলমূলে ১৩ একর ৬২ শতাংশ জায়গা তাঁরা কেনেন। বাকি ৬ একর ১ শতাংশ জায়গা তাঁদের দখলে নয়। জায়গা নিয়ে কটন টেক্সটাইলের সঙ্গে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে দুটি মামলা চলছে।

জায়গার দাবি করে গত মঙ্গলবার রাতে আশুলিয়ায় সংবাদ সম্মেলন করে চারটি পক্ষ। সেখানে কটন টেক্সটাইলের নির্বাহী পরিচালক শাকেরুল কবির বলেছিলেন, জমি কেনার পর থেকে তাঁরা জমি দখলের চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু আশুলিয়া থানায় করা মামলায় জায়গাটি নিজেদের দখলে রয়েছে বলে কেন উল্লেখ করেছেন, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

ছয় বছর আগের ঘটনায় মামলা
সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দখলে থাকা ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ জায়গা নিজের দাবি করে গত ২৩ অক্টোবর আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। এরপর ২৫ অক্টোবর থেকে তিনি জায়গার ওপর দেয়াল নির্মাণ শুরু করেন। মামলায় তিনি ছয় বছর আগের একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ওই দিন জাফরুল্লাহর নির্দেশে তাঁর জায়গা দখল করে নেওয়া হয়।

ছয় বছর পর কেন মামলা করলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নাছির উদ্দিন বলেন, উল্টো মামলা-হামলার ভয়ে তিনি এত দিন আইনি পদক্ষেপ নেননি। এখন সুযোগ মিলেছে, অন্যরাও দখল করছে, তাই তিনিও তাঁর জায়গা দখলে নিয়েছেন।

আবদুস সালাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা কখনোই তাঁর জায়গার বিষয়ে কিছু বলেননি। হঠাৎ এসেই দখল শুরু করেছেন।