যশোরে ছয়টি আসনে আ. লীগ ও বিএনপিতে প্রার্থীজট

কাজী নাবিল আহমেদ,খালেদুর রহমান ও শাহীন চাকলাদার
কাজী নাবিল আহমেদ,খালেদুর রহমান ও শাহীন চাকলাদার

যশোরের ছয়টি সংসদীয় আসনেই আওয়ামী লীগের সাংসদ রয়েছেন। সাংসদদের বিরুদ্ধে দলের একাধিক প্রার্থী জোট বেঁধেছেন। প্রত্যেকটি আসনে একাধিক প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের আশায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তবে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে না নামলেও ভেতরে-ভেতরে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির মধ্যেও প্রার্থী জট রয়েছে। কোনো আসনেই বিএনপির তৃণমূল নেতারা শরিকদের ছাড় দিতে চান না।

যশোর-১ (শার্শা)
এ আসনে পরপর দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন শেখ আফিল উদ্দীন। এ আসনে তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। তবে এবার দলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশায় আরও একজন এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর ফোরামের সদস্য ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদ।

২০০১ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে রাজনীতির মাঠে আসেন শিল্পপতি শেখ আফিল উদ্দীন। যদিও তিনি বিএনপির প্রার্থী আলী কদরের কাছে ১২ হাজার ভোটে হেরেছিলেন। ২০০৮ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী আজিজুরকে পরাজিত করে তিনি প্রথমবার সাংসদ হন। আর ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাংসদ হন। এরপর থেকেই স্থানীয় আধিপত্য নিয়ে দলটির মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়। দলের একাংশ আফিলের বিপক্ষে গিয়ে বেনাপোল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলমের অনুসারী হন।
আশরাফুল বলেন,‘সাংসদ আফিল উদ্দীনের অনুসারীদের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে শার্শায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তাঁরা রাজনীতি করার মতো আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সেই নেতা-কর্মীরা এখন আমার সঙ্গে এসেছেন। আমি আওয়ামী লীগের কাছে মনোনয়ন চাইব। সেই লক্ষ্যে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি।’
নির্বাচনের প্রস্তুতির ব্যাপারে শেখ আফিল উদ্দীন বলেন, ‘আমার প্রস্তুতি নেওয়ার কী আছে; প্রস্তুতি নেবে দল। শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগ যদি আমাকে মনোনীত করে, তাহলে আমি নির্বাচন করব।
বিএনপিতে মনোনয়নের আশায় বুক বেঁধেছেন চারজন। তবে এই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে আতঙ্কের নাম দলের কেন্দ্রীয় সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি। সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত এই নেতার বহিষ্কারাদেশ সম্প্রতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। যে কারণে শার্শা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে আবার চাঙ্গা ভাব ফিরে এসেছে। যে কারণে তার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা অনেকটা নিশ্চিত।
তবে বিএনপির আরও তিন নেতা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মহসীন কবীর ও শার্শা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান জহির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুজ্জামান মধুর নামও শোনা যাচ্ছে।
তবে ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হিসাব-নিকাশে এ আসনে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জে পড়তে হতে পারে এবার। কারণ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে জোটের প্রার্থী ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মো. আজিজুর রহমান। ওই নির্বাচনে আজিজুর ৫ হাজার ৮৫৬ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দীনের কাছে পরাজিত হন।

যশোর-২ (ঝিকরগাছা ও চৌগাছা)
এ আসনে দুই উপজেলাতেই আওয়ামী লীগে চরম দ্বন্দ্ব-সংঘাত রয়েছে। আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীক চান, এমন ব্যক্তির সংখ্যা অর্ধ ডজনের বেশি। তাঁদের অন্তত তিনজন প্রভাবশালী নেতা। বিএনপিও খুব একটা স্বস্তিতে নেই। দলটির বড় মাথাব্যথা দলীয় কোন্দল নয়, বরং জোটের শরিক জামায়াত। কারণ, ভোটের হিসেবে দুই দলই সমানে সমান। জোটবদ্ধ দুটি নির্বাচনেই আসনটি জামায়াতের ভাগে ছিল।

এ আসনের বর্তমান সাংসদ মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। এবার তাঁর পক্ষে ‘নৌকার টিকিট’ পাওয়া খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন দলের লোকজন। কারণ দুটি উপজেলাতেই দলের ভেতরে সাংসদবিরোধী বলয় গড়ে উঠেছে। ঝিকরগাছায় এর নেতৃত্বে আছেন আরেক মনিরুল ইসলাম। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। চৌগাছায় সাংসদবিরোধী অংশের নেতৃত্বে আছেন এস এম হাবিবুর রহমান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান মনিরুল ইসলাম। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মো. রফিকুল ইসলামও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। বঞ্চিত হওয়ায় বিদ্রোহ দেখান। সেই থেকে ঝিকরগাছা ও চৌগাছায় আওয়ামী লীগে বিভক্তি।
সাংসদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আগের এমপিরা ঢাকায় পড়ে থাকতেন। লোকজন তীর্থের কাকের মতো তাঁদের এলাকায় ফেরার অপেক্ষায় থাকত। আর এখন লোকজন বলে, এমপি সাহেব কখন ঢাকায় যাবেন। জনগণ আমাকে সব সময় পাশে পাচ্ছে।’
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও হুইপ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি পুরোদমে নির্বাচনী মাঠ গোছাচ্ছি।’
এর বাইরে আরেক প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) মো. নাসির উদ্দীন। তিনি আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মহাজোটের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা। মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আরও অন্তত পাঁচজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন, আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আলী রায়হান ও কার্যনির্বাহী সদস্য এ বি এম আহসানুল হক, চৌগাছা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম হাবিবুর এবং শিক্ষক হারুন-অর-রশীদ।
২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ ছিল। এখানে প্রার্থী হন জামায়াত নেতা আবু সাঈদ মো. শাহাদাৎ হুসাইন। তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোস্তফা ফারুক মোহম্মদের (প্রয়াত) কাছে হেরে যান।
এবার সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য সাবিরা নাজমুল। ‘ধানের শীষ’ প্রতীক পেতে আরও তিন নেতা প্রস্তুত আছেন। তারা হলেন, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ও চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলাম এবং এখানে দুবার ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে ভোট করা মো. ইসহাক। ইসহাক বর্তমানে যশোর জেলা বিএনপির সহসভাপতি।
পরিসংখ্যান বলছে, যশোর-২ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের ভোট প্রায় কাছাকাছি। আসনটি এবারও ভাগে পেতে তৎপর জামায়াত। সম্ভাব্য প্রার্থী জামায়াত নেতা আবু সাঈদ। তিনি দলটির যশোর জেলা কমিটির নায়েবে আমির। বিএনপির নেতারা বলছেন, এবার এ আসনে জামায়াতকে ছাড় দিতে রাজি নয় বিএনপি।

যশোর-৩ (সদর)
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে শাহীন চাকলাদারের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। অনেক দিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা খালেদুর রহমান টিটোও এখন অনেকটা সক্রিয়। তিনিও নতুন করে নৌকার ‘মাঝি’ হতে চাইছেন। এ আসনে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ছিলেন একক প্রার্থী। সম্প্রতি তিনি মারা যাওয়ায় দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হন আওয়ামী লীগের কাজী নাবিল আহমেদ। এ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারও মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। নাবিল মনোনয়ন পাওয়ার খবরে সে সময় শাহীনের অনুসারীরা শহরের রাস্তায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান। সেই থেকে নাবিলের সঙ্গে শাহীনের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এবারও শাহীন চাকলাদার এ আসনে কাজী নাবিলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের জেলা শাখার নেতৃত্বে রয়েছেন শাহীন চাকলাদারের অনুসারীরা। আর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সদর উপজেলা ও শহর শাখার নেতৃত্বে নাবিল আহমেদের অনুসারী। দুই পক্ষ এখন আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। যে কমিটি যে নেতার অনুসারী, সেই কমিটির কর্মসূচিতে সেই নেতা প্রধান অতিথি বা প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ দেন।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘অধিকাংশ সময় কাজী নাবিল আহমেদ ঢাকায় অবস্থান করেন। যখন যশোরে আসেন তখন আবার তাঁর কাছে দলীয় কর্মীদের পৌঁছাতে তিনটি ঘাট পার হতে হয়। এমনকি নেতা-কর্মীদের কারও ফোন তিনি ধরেন না।’
তবে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘শাহীন চাকলাদারের অভিযোগ ঠিক নয়। আমার দুয়ার সবার জন্যই খোলা। বরং শাহীনের কাছে মানুষ যেতে ভয় পায়। তিনি দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক।’
২০০৮ সালের সাংসদ খালেদুর রহমান মনোনয়ন না পেয়ে টানা চার বছর কোনো পক্ষের সঙ্গেই নেই। তবে গত দুই বছরে খালেদুর কিছুটা সক্রিয়। মাঝেমধ্যে তাঁকে রাজপথে দেখা গেছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে নিজের অনুসারীদের নিয়ে কয়েক বার শক্তির মহড়া দিয়েছেন।

তরিকুল ইসলাম ছিলেন দক্ষিণবঙ্গে দলের প্রতাপশালী একক নেতা। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। যদি তার মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে দলে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। অমিত দলের খুলনা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।
নির্বাচন করবেন কিনা জানতে চাইলে অনিন্দ্য ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে কি না, সেটা এখনো অনিশ্চিত। ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সময় বলবে আমি কী করব।’ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হকও এ আসনে প্রার্থী হতে চান। নির্বাচনী প্রচারে না নামলেও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি নিবিড় যোগযোগ রেখে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সৈয়দ সাবেরুল হক বলেন,‘দল নির্বাচনে আসবে কিনা। এখনো নিশ্চিত না। দল নির্বাচনে এলে আমি মনোনয়ন চাইব। কারণ তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাওয়া আমি নির্বাচন করি।’
জাসদ (ইনু) থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি ও যশোর জেলা কমিটির সভাপতি শেখ রবিউল আলম প্রার্থী হতে পারেন।

যশোর-৪ (বাঘারপাড়া, অভয়নগর ও সদরের একাংশ)
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সংসদীয় আসনে শিল্পনগর ও নৌবন্দর রয়েছে। ভবদহ সমস্যাটিও এখানে প্রকট। সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সম্ভাবনা। এ আসনে বর্তমান সাংসদ রণজিত কুমার রায়। এর বাইরে আরও কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তারা হলেন অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও নওয়াপাড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র এনামুল হক ফারাজি, সাবেক সাংসদ ও হুইপ আবদুল ওহাব, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নাজমুল আলম কাজল ও কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আমজাদ হোসেন।
তবে এ আসনে মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ইকবাল কবির জাহিদের নির্বাচনী সভা সমাবেশ চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি বাঘারপাড়ায় এক জনসভায় এ আসনে দলের প্রার্থী হিসেবে ইকবাল কবিরের নাম ঘোষণা করেন মন্ত্রী ও দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ আসনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ যাবৎ কোনো সাংসদই এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে সংসদের জোড়ানো দাবি তোলেননি। যে কারণে এলাকার মানুষ এবার পরিবর্তন চায়। মহাজোটের শরিক হিসাবে এ আসনটি নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেনদরবার চলছে।
এদিকে এ আসনে বিএনপি অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য টিএস আইয়ুব এ আসনে অনেকটা চূড়ান্ত। তার বিরুদ্ধে তেমন শক্ত কোনো প্রতিপক্ষের নাম শোনা যায়নি।

যশোর-৫ (মণিরামপুর)
এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চান আপন দুই ভাই। এক ভাই বর্তমান সাংসদ স্বপন ভট্টাচার্য ও অপর ভাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাংসদ ও দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য। নৌকার মাঝি হতে দুই ভাই-ই দলীয় সভানেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া আরও কয়েকজন মনোনয়নের আশায় বুক বেঁধেছেন।
এদিকে বিএনপি প্রার্থীরা এবার এ আসনটি জোটের শরিকদের কাছে ছাড়তে নারাজ। কারণ গত ১০ বছরে মণিরামপুর উপজেলায় বিএনপির ১২ জন নেতাকর্মী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের এ ত্যাগের মূল্যায়ন চান বিএনপির প্রার্থীরা।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জমায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন হয়। ওই নির্বাচনে এ আসন থেকে জোটের শরিক জমিয়তে ওলামা ইসলামের কেন্দ্রীয় আমির মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খান টিপু সুলতানকে (মরহুম) ২১ হাজার ৫৪ ভোটের পরাজিত করে ওয়াক্কাস সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৬ হাজার ১৭৫ ভোটে ওয়াক্কাসকে পরাজিত করে সাংসদ হন খান টিপু। যে কারণে জোটগত নির্বাচনে এ আসনে ওয়াক্কাসের মনোনয়ন দেওয়া না দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুহাম্মদ ওয়াক্কাস বলেন, ‘আমাকে ভোট দেওয়ার জন্য মণিরামপুরের মানুষ প্রস্তুত হয়ে আছে। ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করব। আমি পাশ করব বলে আশাবাদী। কারণ এর আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ১৯৮৬ সালে, এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৮৮ সালে ও বিএনপি-জামায়াত ইসলামী জোট থেকে ২০০১ সালে আমি সাংসদ নির্বাচিত হই।’
তবে বিএনপি এ আসন থেকে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের এককভাবে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বর্তমান উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র শহীদ ইকবাল হোসেন। তিনি এবারও নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তৎপর রয়েছেন।
এখানে শহীদ ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন দলের আরও কয়েকজন প্রার্থী। তারা হলেন যশোর শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুনীর আহম্মেদ সিদ্দিকী, যশোর জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মুসা, সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক মেসবাহ উর রহমান, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ইফতেখার সেলিম অগ্নি। জামায়াতে ইসলামী থেকে জোটের মনোনয়ন চান জেলা শূরা সদস্য গাজী এনামুল হক।
বর্তমান সাংসদ স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘বড় ভাই (পীযুষকান্তি ভট্টাচার্য) দলীয় মনোনয়ন পেলে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে ১৯৮৬ সালের পর থেকে তিনি এলাকায় যাননি। মণিরামপুরের ১৭টি ইউনিয়নের নাম তিনি বলতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে।’
এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের তিনবারের নির্বাচিত সাংসদ খান টিপু সুলতান বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী চিকিৎসক জেসমিন আরা বেগম স্বামীর অনুসারীদের নিয়ে নির্বাচনী সভা-সমাবেশ করছেন। এসব সভা-সমাবেশে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে ঘোষণা দেন। তবে তাঁর ঢাকার বাসা থেকে বছর তিনেক আগে পুত্রবধূ চিকিৎসক শামারুখ মাহজাবীনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দেশব্যাপী বিতর্কের ঝড় ওঠে। শামারুখের বাবা নুরুল ইসলাম রাজধানীর একটি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় সাবেক সাংসদ খান টিপু সুলতান, স্ত্রী জেসমিন আরা বেগম ও ছেলে সাদাব সুলতানকে আসামি করা হয়। পরে অবশ্য আদালত এটিকে আত্মহত্যা বলে রায় দিয়েছেন।
এখানে আরও কয়েকজন দলীয় মনোনয়ন চান। তাদের মধ্যে অনেকে এলাকায় গণসংযোগ করছেন। সম্প্রতি জনসংযোগে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন, জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল হাসান বারীকে।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির যশোর জেলা শাখার সভাপতি শরিফুল ইসলাম চৌধুরী ও জাগপার জেলা নেতা নিজামউদ্দীন অমিতের নাম শোনা যাচ্ছে।

যশোর-৬ (কেশবপুর)
এ আসনে বর্তমান সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক। দলের মধ্যে মন্ত্রী বিরোধী একটি শক্তিশালী বলয় দাঁড়িয়ে গেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বড় অংশ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরোধিতা করেছে।
এখানে আরও কয়েকজন নৌকার মাঝি হতে তৎপর রয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এইচ এম আমির হোসেন ইসমাত আরার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ছাড়া মনোনয়ন চান মনোনয়ন চান চলচ্চিত্র নির্মাতা ওয়াহেদ সাদেক,পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম মোড়ল, আইনজীবী হুসাইন ইসলাম, বীমা ব্যক্তিত্ব শেখ রফিক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাজী রফিকুল ইসলাম ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম রুহুল আমিন।
এদিকে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে কয়েকজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে আছেন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন আজাদ। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অমেলেন্দু দাস অপু, জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবু বকর আবু ও পৌর কমিটির সভাপতি আবদুস সামাদ বিশ্বাস। এ ছাড়া জাকের পার্টি থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রভাষক শহিদুজ্জামান জনসংযোগ করছেন।