একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, তবু অনিশ্চয়তা!

শাকিল বাবু
শাকিল বাবু

এসএসসিতে ফরম পূরণ করার সময় শাকিল বাবুকে টাকা দিতে পারছিলেন না বাবা। একপর্যায়ে শাকিলকে বলে দিলেন, ‘পড়াশোনা করে লাভ নাই। মানুষের বাড়িতে গিয়া কাজকর্ম করো। তবে সংসারটা চলবে।’ এসব শুনে শাকিল ওই সময় ঘরে শুয়ে গুমরে কাঁদেন। পরের দিন প্রতিবেশী এক ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। তিন দিন ওই ব্যক্তির সঙ্গে মাঠে গিয়ে ধান কাটেন। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, রাতযাপন।

এরপর শাকিল ওই ব্যক্তির কাছে ফরম পূরণের টাকা চান এবং বলেন, ধান কেটে দিয়েই পুরো টাকা পরিশোধ করবেন। শাকিলের ভাষায়, ‘ওই ব্যক্তি দয়া করে আমাকে আগাম টাকা দিলেন। ফরম পূরণ করলাম।’ এইচএসসিতে ফরম পূরণের সময়ও ছিল একই অবস্থা। হাতে তখন মাত্র ৩০০ টাকা। ফরম পূরণের প্রয়োজন ৩ হাজার ৩০০ টাকা। ওই সময় এলাকায় কাজ ছিল না। পরে পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার নিয়ে এইচএসসির ফরম পূরণ করেছিলাম।’

অদম্য এই শাকিল বাবু এবারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে মেধা তালিকায় ৫৯৫, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটে ৬২৮ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সি’ ইউনিটে ১৭০তম স্থান অধিকার করেছেন। দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তির আবেদনের টাকা দুই বন্ধু তাঁকে দিয়েছিলেন। এখন তিনি ভর্তি হতে চান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির শেষ তারিখ ১৫ নভেম্বর। ভর্তি হওয়ার টাকা নেই তাঁর। এ অবস্থায় শাকিলের দিন কাটছে ঘোর এক অনিশ্চয়তায়।

শাকিলদের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শাহাপুর জেলেপাড়া গ্রামে। বাবা এসফোর আলী মাছ শিকার করে সংসার চালান। মা শেফালি বেগম গৃহিণী। তাঁরা নিরক্ষর। চার সন্তানের মধ্যে শাকিল তৃতীয়। টাকার অভাবে তিন মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। দুই মেয়ের ইতিমধ্যে বিয়ে দিয়েছেন। আবাদি কোনো জমি নেই। আছে তিন শতক বসতভিটা।

শাকিল বাবু ২০১৬ সালে আমরুলবাড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞানে ৪.৭২ এবং ২০১৮ সালে বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে ৪.৬৭ পেয়েছিলেন। শাকিল বলেন, কখনো দিনমজুরির কাজ করে এবং প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে পড়াশোনা করেছি, সংসারেও জোগান দিয়েছি। অনেক বেলা ঘরে খাবার ছিল না। টাকার অভাবে নিজে প্রাইভেট পড়তে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোথাও কোচিং করিনি। বাড়িতে পড়েছি। এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই। এ জন্য প্রয়োজন ১০ হাজার ৪০০ টাকা। বাবা হাঁস-মুরগি বিক্রি করে দুই হাজার টাকা দিয়েছেন। ভর্তি হলে থাকা-খাওয়া মিলে প্রতি মাসে লাগবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা। বাড়ি থেকে বাবার পক্ষে টাকা জোগান দেওয়ারও উপায় নেই। তাই ভর্তি ও থাকা-খাওয়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুমাতেও পারছি না।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে শাকিল বাবুর। তিনি আরও বলেন, ‘ভর্তি হতে পারলে প্রয়োজনে রিকশা চালাব। তবু পড়াশোনা করতে চাই। প্রকৃত মানুষ হয়ে পিছিয়ে পড়া জেলেপল্লি আলোকিত করতে চাই। চাই, আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করতে।’

শাকিলের বাবা এসফোর আলী বলেন, মাছ ধরি বিক্রি করি সংসার চলাওঁ। এ্যালা (এখন) নদীত বিলোত (বিলে) পানিও নাই। মাছও নাই। খুব কষ্ট সংসারোত। শাকিলোক পড়ার মোতোন মোর কোনো অবস্থা নাই। ছইলটা (শাকিল বাবু) ঢাকাত চলি গেইলে মোর আরও মরণ। কারণ মানুষের বাড়িত কাজকাম করিয়া সংসারোত কিছু করি টাকা দিছিল।’

সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাদেক আলী মণ্ডল বলেন, জেলেপাড়া গ্রামে অন্তত দেড় হাজার মানুষের বসবাস। দু-একজন ছাড়া গ্রামের সবাই হতদরিদ্র। পড়াশোনা করছে মাত্র ৬-৭ জন ছেলেমেয়ে। গ্রামের মধ্যে এই প্রথম শাকিল বাবু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। টাকার অভাবে তাঁর ভর্তি হওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মু. মাজেদ আলী খাঁন বলেন, ‘শাকিল সব বাধা পেরিয়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। পড়াশোনায় একটু সহযোগিতা পেলে বিশ্বাস করি সে ভালো কিছু করতে পারবে।’

শাকিল বাবুকে সহযোগিতা করতে বিকাশ নম্বর ০১৯৩৭৭০৭৭৪৭। ব্যক্তিগত যোগাযোগ ০১৭৭৩২৪৭৩৭২।