পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত

অভিজিৎ রায়
অভিজিৎ রায়

নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (পুরোনো নাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্যরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন বছর পর ওই হত্যা মামলায় আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, অভিজিৎ রায় হত্যায় আনসার আল ইসলামের ১১ জঙ্গির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে পাঁচ জঙ্গির পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা পাওয়া যায়নি। একজন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে মোট ছয়জনের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য জঙ্গিরা হলেন আরাফাত রহমান ওরফে শামস ওরফে সাজ্জাদ, মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক ওরফে সোহেল ওরফে সাকিব ও আকরাম ওরফে আদনান।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, অভিজিৎ রায় মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে তা আদালতে জমা দেওয়া হবে।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে দুর্বৃত্তরা অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ ওরফে বন্যাকে গুরুতর আহত করে। তাঁরা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে সফটওয়্যার প্রকৌশলী ছিলেন, রাফিদা চিকিৎসক। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় করা হত্যা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। পরে মামলার তদন্তভার ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগে (সিটি) ন্যস্ত করা হয়। হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের খবর দেয় জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারি করা ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।’ বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলে আসছে, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই।

মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে খুন হওয়ার দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা) সিসি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক প্রশিক্ষক শরিফুল, শারীরিক প্রশিক্ষক সেলিম, সাজ্জাদসহ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাত-আটজনকে দেখা যায়। তাঁরা বইমেলায় ঢোকা এবং সেখান থেকে বের হওয়া পর্যন্ত অভিজিৎ রায়ের গতিবিধি অনুসরণ করেন।

পুলিশ অভিজিৎ রায় হত্যায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে সায়মন, সোহেল ও আরাফাত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আরেকজন আইটির (তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি) প্রধান ও সামরিক প্রশিক্ষক মুকুল রানা ওরফে শরিফুল মেরাদিয়ায় ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

তদন্ত–সংশ্লিস্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেওয়া তাঁদের জবানবন্দি এবং তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে অপপ্রচার ও মহানবী (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি করায় জঙ্গিনেতা সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার নির্দেশ ও পরিকল্পনা এবং শারীরিক প্রশিক্ষক সেলিমের উপস্থিতিতে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করেন। হত্যার দুদিন আগে থেকে জঙ্গি সায়মন, সোহেল, আকরাম ও হাসান অভিজিৎ রায়ের গতিবিধি অনুসরণ করেন। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে আরাফাত, খলিল ওরফে আলী, অন্তু ও অনিক হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। এ সময় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া, শরীরচর্চা প্রশিক্ষক সেলিমসহ ঘটনাস্থল ঘিরে রাখেন। যাতে তাঁদের সহযোগীদের কেউ আটক করতে না পারে। হত্যাকাণ্ডের পর তাঁরা ঘটনাস্থলে হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি ফেলে পালিয়ে যান।

তদন্ত সূত্র জানায়, জঙ্গি সেলিম, গোয়েন্দা তথ্য (ইনটেল গ্রুপ) সংগ্রহকারী দলের সদস্য হাসান, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া খলিল, অন্তু, অনিকের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা না পাওয়ায় তাঁদের মামলার অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তার করা গেলে পরে তাঁদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।