অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পাঠ-এর সমাপনী অনুষ্ঠান

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছবি: প্রথম আলো

বাঙলার পাঠশালা পরিচালিত পাঠচক্র-৯,‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি: অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পাঠ’-এর চার মাসব্যাপী পাঠচক্র শেষ হয়েছে। আজ পাঠচক্রের সমাপনী অনুষ্ঠান হলো। সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচনা করেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. এম. আকাশ। চার মাসব্যাপী পাঠচক্রের বিষয়গুলো ছিল: আনিসুজ্জামানের জীবন ও কর্ম, তাঁর সংস্কৃতি, শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্য চিন্তা, আনিসুজ্জামানের গবেষণা, ভাষা আন্দোলন, যুবলীগ, রবীন্দ্র বর্জন বিরোধিতা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতা, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ, স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্লেষণ, বাঙালির আত্মপরিচয়: আনিসুজ্জামানের অনুসন্ধান, বাংলা বানান অভিধান ও ফরাসি-বাংলা অভিধান এবং বাংলাদেশ সংবিধানের পরিভাষা এবং সবশেষে আনিসুজ্জামানের মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্র, সংবিধান ও যুদ্ধাপরাধের বিচার পাঠ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্র সাধারণ শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে মাদ্রাসা-শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা না করতে পারত। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে দেশে বর্তমানে একাধিক শিক্ষার পদ্ধতি বিদ্যমান। মাদ্রাসা-শিক্ষার বিষয়টি সমাজের ওপর ছেড়ে দিতে পারত। তা না করে, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে আমরা একটি বিভক্ত সমাজ পেয়েছি। অনেকে ধর্ম-শিক্ষা ও মাদ্রাসা-শিক্ষাকে অভিন্ন করে দেখেন। সেটি ঠিক নয়। কারণ, ধর্ম-শিক্ষা আমরা অন্যভাবেও পেতে পারি। আবার মাদ্রাসা-শিক্ষার ভেতরও তিনটি ভাগ: আলিয়া ধারায় ২টি আর একটি হলো কওমি ধারা। সমাজের প্রচলিত বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা একটি বিভক্ত সমাজ তৈরি করেছে। এই বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে কোনো ঐক্য তৈরি করতে পারে না।

তরুণদের সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনে করেন, তরুণদের সম্পর্কে সাধারণ যে ধারণা তারা দেশ ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন নয় এটি ঠিক নয়। তার কারণ, শাহবাগ আন্দোলন তো ব্যাপকভাবে তরুণেরাই সংগঠিত করেছিল ও তারাই নেতৃত্ব দিয়েছিল। পরবর্তীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন তো যারা এখনো তরুণ হয়নি তারা সুস্পষ্টভাবে তাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে তারা এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন। তা না হলে এ রকম আন্দোলন তারা করতে পারত না। তবে এটি ঠিক যে, যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে তারা ব্যান্ড মিউজিকের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিভক্তির কারণে এমনটি হয়েছে। কিন্তু এর জন্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যারা দেশের বাইরে যাচ্ছে তারা বেশির ভাগই ভালো করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের অবদান কম কৃতিত্বের কথা নয়। কিন্তু যারা বিদেশে গিয়ে দেশের প্রতি আগ্রহ একবারে হারিয়ে ফেলছে তাদের নিয়ে আমাদের ভাববার রয়েছে। তরুণদের মধ্যে যারা দেশের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে তাদের অসন্তোষ দেখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র তার কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেন নৃতাত্ত্বিকভাবে আমরা বাঙালি হতে পারি, চাকমা বা সাঁওতাল হতে পারি তবে অন্য দিকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা হলো তারা এ দেশের অন্য নৃ-গোষ্ঠীর স্বতন্ত্রতা বুঝতে পারেনি। আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো একেবারে ধর্মীয়। এখানে তারা অন্য নৃ-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত দূরে থাকে তারা কেবল মুসলিম ধর্মের সংকীর্ণ চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত যা বাঙালির অন্য ধর্মাবলম্বিদের ও নৃ-গোষ্ঠী বাদ দেয়।

দুই বাংলার ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, মুখের ভাষাই লিখিত ভাষার দিক নির্ণয় করে। স্থান-কালের পার্থক্যের জন্য ভাষার পার্থক্য হয়। বাধা পেলে অথবা প্রতি ৫০ মাইল পর মুখের ভাষা বদলে যায়। আমরা আরবি-ফারসি শব্দ বেশি ব্যবহার করি কিন্তু পশ্চিম বঙ্গে সংস্কৃত শব্দ হয়তো বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বাক্যের গঠন ও শব্দার্থ বদলায়নি কিন্তু শব্দের ব্যবহার বদলেছে। আমরা অনুভব করি একই বাংলা ভাষা আমরা দুই রাষ্ট্রে ব্যবহার করি। আমাদের উত্তরাধিকার এক ও আমাদের সামনে চলার পথ এক। এ দুই রাষ্ট্রের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ সমান্তরালভাবে হবে। হয়তো কখনো কখনো এক ধারা থেকে অন্য ধারা দূরবর্তী হবে কিন্তু দুটোতেই বাঙালি সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হবে।

সমাপনী অনুষ্ঠানটি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ২০১৭ নম্বর কক্ষে (দ্বিতীয় তলা) ২৪ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার, বিকেল ৫টায়।