বিতর্কিতরা আবারও আ.লীগের প্রার্থী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের গতকাল চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাতে বাদ পড়া ব্যক্তিদের তালিকা খুব দীর্ঘ নয়। বরং বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত ও বিতর্কিত অনেক প্রার্থী পেয়েছেন দলীয় মনোনয়ন। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরোধিতা থাকলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। জানা গেছে, ব্যতিক্রম ঘটেছে সরকারদলীয় দুই সাংসদ আবদুর রহমান বদি ও আমানুর রহমান খানের ক্ষেত্রে। এ দুজনকে বাদ দেওয়া হলেও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যরা।

সরকারি দলের সমালোচিত সাংসদদের মধ্যে আবার মনোনয়ন পেলেন এ কে এম শামীম ওসমান, শেখ আফিল উদ্দিন, রণজিত কুমার রায়, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, শওকত হাচানুর রহমান, আ স ম ফিরোজ, ফাহমি গোলন্দাজ, ওমর ফারুক চৌধুরী, মনোরঞ্জন শীল, আবদুল ওয়াদুদ দারা, নিজাম উদ্দিন হাজারী প্রমুখ।

বদির বদলে স্ত্রী, আমানুরের বদলে বাবা
নেশার বড়ি ইয়াবা চোরাচালানের হোতা হিসেবে ব্যাপক সমালোচিত কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাংসদ বদি। সরকারের একাধিক সংস্থার তৈরি ইয়াবা চোরাচালানকারীর তালিকায় বদির নাম শীর্ষে। কক্সবাজার থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সমালোচনার মুখে বদির পরিবর্তে স্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণায় দলের অনেকে ক্ষুব্ধ। শাহীন আকতার গৃহবধূ। দলের কোনো কমিটিতে তাঁর নাম নেই। প্রাথমিক সদস্যপদ আছে কি না, সে বিষয়েও অনেকে সন্দিহান। তিনি উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম নুরুল ইসলাম চৌধুরী ঠান্ডা মিয়ার মেয়ে। তাঁর মনোনয়ন নিয়ে সীমান্তের দুটি উপজেলায় নানা জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বদির হাতে লাঞ্ছিত ও প্রহৃত হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষ।

এ ছাড়া টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাংসদ আমানুর রহমান রানারও ছায়া থাকছে আগামী নির্বাচনে। নিজ দলের এক নেতাকে খুনের অভিযোগে কারাগারে আছেন রানা। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়েছে তাঁর বাবা আতাউর রহমান খানকে। এই খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এলাকার মানুষ।

আছেন আলোচিত–সমালোচিতরা
প্রথম আলোসহ একাধিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে বিতর্কিত সাংসদদের কর্মকাণ্ড। তবে তাঁরা কেউ এবার মনোনয়নবঞ্চিত হননি।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের (ময়মনসিংহ-১০) ফাহমি গোলন্দাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এলাকায় নিজ দলের এবং দলের বাইরের অনেক লোক তাঁর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হাজারো নেতা-কর্মী তাঁর নির্যাতনে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।

সংখ্যালঘুদের জায়গা–জমি দখলের অভিযোগে আলোচিত ঠাকুরগাঁওয়ের সাংসদ দবিরুল ইসলামের। সিপিবি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ছয়বারে গত ২৭ বছর ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাংসদ তিনি। দলীয় পদ, সরকারি সুযোগসুবিধা প্রাপ্তি, নিয়োগ–বাণিজ্য, প্রকল্পের কাজ, চাঁদাবাজি—সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এলাকায়। পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করায় স্থানীয় নেতা-কর্মীর মধ্যেও আছে ক্ষোভ।

রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীদের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম ওঠে।

নিয়োগ, মনোনয়ন, নির্বাচন, উন্নয়ন, নলকূপ বরাদ্দ, টিআর, কাবিখা খাত থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে বরগুনা সদর আসনের সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে। আছে দখল, মারধর, পারিবারিকীকরণের অভিযোগও। এসব অভিযোগ করে গত সেপ্টেম্বরে বরগুনার নেতারা মিলে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

বরগুনা-২ আসনের শওকত হাচানুর রহমানের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় যুদ্ধাপরাধীর সন্তানদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল তিনিও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। তাঁর বাবা খলিলুর রহমান বরগুনায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

চট্টগ্রাম-১৫ আসনে (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আবু রেজা মো. নিজামউদ্দিন নদভী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে জামায়াত–সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা যথাযথ মূল্যায়ন পান না বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে।

দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপালকে গত বছর বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলেজের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে নামকরণ, এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, দলীয় নেতা-কর্মীদের অবজ্ঞা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করে জামায়াত-বিএনপিকে বিজয়ী করা, বিদ্যুৎ, টিআর, কাবিখা ও নিয়োগে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ এনে তারা ওই ঘোষণা দেয়।

বর্তমান সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ আলোচিত হন নিজ নির্বাচনী এলাকা পটুয়াখালীর বাউফলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সমর্থকদের কাছে ক্রেস্টের বদলে ক্যাশ (নগদ অর্থ) চাওয়ার বক্তব্য দিয়ে। সাংবাদিক ‘নির্যাতনকারী’ হিসেবেও তিনি আলোচিত। আবার সুদ মওকুফের পর সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পুনঃ তফসিল হাইকোর্ট স্থগিত করায় তাঁর নির্বাচন করা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল।

বরিশাল-৪ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ করে আসছে ওই এলাকার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের একাংশ।

নানা কারণে দীর্ঘ সময় ধরে সমালোচিত ও বিতর্কিত সাংসদ নারায়ণগঞ্জের এ কে এম শামীম ওসমান। দলীয় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর হামলার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সীমান্তে চোরাচালান ও হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে যশোরের শার্শা উপজেলায় ৯ বছরে আওয়ামী লীগের ৩৭ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর জের ধরে খুন হয়েছেন দলীয় কর্মীদের চার সন্তানও। এসব ঘটনায় করা মামলার একটিরও বিচার হয়নি। বাদীপক্ষের অভিযোগ, অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের বেশির ভাগ যশোর-১ (শার্শা) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের অনুসারী। ১০ বছর ধরেই সাংসদের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন তাঁরা।

যশোর-৪ আসনের সাংসদ রণজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধেও ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিলেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার নেতা-কর্মীরা। রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুর আসনের সাংসদ আবদুল ওয়াদুদের বিরুদ্ধে নিয়োগ–বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগ আছে। সাংসদ হওয়ার পর তাঁর অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি নিয়েও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

ফেনীতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন ফেনী-২ আসনের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী। অস্ত্র মামলায় কারাগারে গেলেও দুই বছর ১০ মাস কম সাজা খেটেই বেরিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

মাত্র পাঁচ বছরে ঝালকাঠির সাংসদ বজলুল হক হারুনের (বি এইচ হারুন) পরিবার বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের নানা অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। মনোনয়ন পেয়েছেন তিনিও।