নেতাদের দ্বন্দ্বে জাপায় তিন ধারা

রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে এই বিভক্তি স্থানীয়ভাবে দলটির অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ফেলেছে। ধস নেমেছে দলের জনপ্রিয়তায়ও। এই অন্তঃকোন্দলের নেতিবাচক প্রভাব নির্বাচনের ফলাফলেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।

জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা জানান, জাতীয় পার্টির জন্মলগ্ন থেকে এলাকায় দলকে সংগঠিত করে রেখেছিলেন মোহাম্মদ আলী সরকার। তিনি ২০০১ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লাঙ্গল প্রতীকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তাঁকে বাদ দিয়ে ওই আসনে ব্যবসায়ী আনিছুল ইসলাম মণ্ডলকে মনোনয়ন দিলে নেতা-কর্মীরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এরপর আনিছুল ইসলামকে বাদ দিয়ে ২০১৩ সালের ২ মার্চ হঠাৎ বদরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি করা হয় বদরগঞ্জ উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে সাবলু চৌধুরীকে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে তাঁকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দিয়ে পরে তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এরপর নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং দলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে তিনটি পক্ষের সৃষ্টি হয়।

জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, জাতীয় পার্টির রংপুর জেলা কমিটির সদস্য আনিছুল ইসলাম মণ্ডল, বদরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে সাবলু চৌধুরী এবং জাতীয় আইনজীবী ফেডারেশনের রংপুর বিভাগীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোকাম্মেল হক চৌধুরী তিনটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা ওই আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য জাতীয় পার্টির দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে জমাও দিয়েছেন।

নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, স্থানীয়ভাবে দলে বিভক্তি, জাতীয় পর্যায়সহ ওই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচনে এরশাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, স্বেচ্ছাচারিতা এবং দলের স্থানীয় পর্যায়ে কোন্দল ও বারবার নেতৃত্ব পরিবর্তনের কারণে দলের প্রতি তৃণমূলের কর্মীরা বিমুখ হয়ে পড়েছেন। এতে জাতীয় পার্টি সম্পর্কে এলাকায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এলাকায় আগের মতো এরশাদের লাঙ্গল প্রতীকে সাধারণ মানুষের আর তেমন মোহ নেই।

জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে, তার প্রমাণ মিলেছে গত পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। বদরগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে এরশাদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে জাপা নেতা লাতিফুল খাবির ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ১৭১টি। বদরগঞ্জ উপজেলার ১০ ইউনিয়নের মধ্যে মধুপুর, দামোদরপুর, লোহানীপাড়া, কালুপাড়া ও রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের বিগত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি। অন্য পাঁচ ইউনিয়ন পরিষদে প্রার্থী দিলেও সবাই জামানত হারিয়েছেন। অন্যদিকে তারাগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে গত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা চারটিতে পরাজিত হয়েছেন।

জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির আনিছুল ইসলাম মণ্ডল ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৭১ ভোট পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম ভোট পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ৫৭৮। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাপার প্রার্থী মোহাম্মদ আলী সরকার লাঙ্গল প্রতীকে ৯১ হাজার ৮৯১ ভোট পেয়ে সাংসদ হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রয়াত আনিসুল হক চৌধুরী ভোট পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ১৬৪টি । ২০১৪ সালে ওই আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েও প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বিনা ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী।

তারাগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সহসাধারণ সম্পাদক তুহিনুর ইসলাম বলেন, ‘তিন ভাগে নয়, জাতীয় পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তি ও স্থানীয় নেতৃত্বে বারবার রদবদলে দলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে সাবেক সাংসদ আনিছুল ইসলামের নেতৃত্বে দল অনেকটা সংগঠিত রয়েছে।

>নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের জেরে দলে তিনটি পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। আনিছুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান ও মোকাম্মেল হক এই তিন ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তারাগঞ্জ হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ‘হামার দলের কতা কী আর কইমেন। স্যার (এরশাদ) যাকে মনোনয়ন দেয়, এমপি হয়া তায় পালে যায়। গতবার এইটা আসোনোত জাতীয় পার্টির এমপি না থাকায় দলের খুব ক্ষতি হইছে। তাতে করি লাঙ্গল মার্কার লোকজনও হতাশ হয়া পড়ছে।’

বদরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সমর্থক নুরন্নবী ইসলাম বলেন, ‘ভোট আসলে নাঙ্গোলোত ভোট দিই। এরশাদ ঢাকাত বসি যাক খুশি তাক প্রার্থী করে। এইটা কোনো কতা হইলো। একটা পার্টির তো নীতি থাকপে। হামরা এত দিন নাঙ্গলোত ভোট দিয়া ভুল করচি।’

জাতীয় পার্টির একটি ধারার নেতৃত্বে থাকা দলের সাবেক সাংসদ আনিছুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি ছিল রংপুর-২ আসনটি। কিন্তু সাবলু চৌধুরী দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর দলের বারোটা বাজিয়েছেন। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা বর্তমানে আমার সঙ্গে রয়েছেন। স্যার (এরশাদ) খোঁজখবর নিয়ে যদি আসন্ন নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেন, তবে আসনটি পুনরায় জাতীয় পার্টির দখলে ফেরাতে পারব, ইনশা আল্লাহ।’

অপর ধারার নেতৃত্বদানকারী মোকাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সাবলু চৌধুরী দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর থেকে জাতীয় পার্টি তছনছ হয়ে গেছে। এখনো সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলে জাতীয় পার্টিকে পুনরায় সংগঠিত করা সম্ভব।’

দলকে তছনছ করা এবং দলের বারোটা বাজানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আসাদুজ্জামান।