আচরণবিধি লঙ্ঘনের মচ্ছব

সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে আবদুল মোমেনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নিজের গাড়ি ও পুলিশ প্রটোকল নিয়ে আসেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।  ছবি: প্রথম আলো
সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে আবদুল মোমেনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নিজের গাড়ি ও পুলিশ প্রটোকল নিয়ে আসেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: প্রথম আলো

সিলেটে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে অধিকাংশ প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় থাকা মন্ত্রী, সাংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী বিধি লঙ্ঘন করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের দুটি দলকে বেশ কয়েকবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় প্রাঙ্গণে টহল দিতে দেখা গেছে। এরপরও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নিজেদের প্রতীকের সমর্থনে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে দেখা গেছে।

নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাঁদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবেন না। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোনো ধরনের শোডাউন কিংবা মিছিল করা যাবে না বলেও নীতিমালা রয়েছে। বিধি না মানলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাতজন ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গতকাল প্রার্থীদের অনেকে তারও বেশি লোক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন।

গতকাল বেলা ১১টায় সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস সিলেটের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা কাজী এমদাদুল ইসলামের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়ি নিয়ে তিনি বিপুল কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শোডাউন করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। ১টা ৪০ মিনিটে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। শিক্ষামন্ত্রী তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি গাড়ি নিয়ে আসেননি। তবে এ সময় বিয়ানীবাজার পৌরসভার মেয়র আবদুস শুকুর তাঁর জন্য বরাদ্দকৃত গাড়ি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আসেন। শিক্ষামন্ত্রীর সমর্থনেও তখন নৌকা প্রতীকে স্লোগান হয়।

জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়ি এবং কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন সিলেট–৩ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী।  ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়ি এবং কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন সিলেট–৩ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। ছবি: প্রথম আলো

সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এ কে আবদুল মোমেন তাঁর বড় ভাই অর্থমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে বেলা ২টা ১৮ মিনিটে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে কয়েক শ কর্মী-সমর্থক ছিলেন এবং তাঁরা ‘নৌকা, নৌকা’ বলে স্লোগান দেন। স্লোগান দিয়ে দলটির অন্তত অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। অর্থমন্ত্রী পুলিশ প্রটোকল নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসেন এবং যাওয়ার সময়ও একইভাবে ফেরত যান। সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে মনোনয়নপত্র জমাদানের সময় উপস্থিত ছিলেন।

গতকাল বেলা সাড়ে চারটার দিকে এ কে আবদুল মোমেনের সমর্থনে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সদের অ্যাসোসিয়েশন বৈঠক করে। নগরের ধোপাদিঘিরপাড় এলাকায় মোমেনের বাসভবন হাফিজ কমপ্লেক্সে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি ওই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে নার্সরা সভায় যোগ দেন।

সিলেট-২ (বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর) আসনের জাতীয় পার্টি-সমর্থিত সাংসদ ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী বেলা ২টা ৪০ মিনিটে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে জাতীয় পার্টির বিপুল কর্মী-সমর্থক ছিলেন। সিলেট-৩ আসনে (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ শফি আহমদ চৌধুরী বেলা তিনটায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। এ সময় তাঁর ও তাঁর কর্মীদের হাতে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক দেখা যায়। তাঁরা সে প্রতীক প্রদর্শন করে তখন রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে বিএনপি ও ধানের শীষের সমর্থনে স্লোগানও দেয়।

বেলা সাড়ে চারটায় সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ হাফিজ আহমদ মজুমদার মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। এ সময় তাঁর সমর্থকেরা মুহুর্মুহু নৌকার স্লোগান দেন। দিনভর প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদানের সময় এ রকম আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে অন্তত ১৫ জনকে দেখা গেছে।

পুলিশ প্রটোকলের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমি পুলিশ প্রটোকল হিসেবে আসিনি। আমি বলেছিলাম আমার কোনো প্রটোকলের প্রয়োজন নেই। তারা (পুলিশ) বলেছে প্রটোকল নয়, নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।’

জানতে চাইলে সিলেটের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো স্লোগান বা শোডাউন হয় নাই। যেটা হয়েছে, একজন প্রার্থী বোধ হয় চলে যাচ্ছিল, তখন আরও কয়েকজন বিরোধীরা হইচই করেছে। শুধু একবার এমন হয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে।’

প্রার্থীদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের সরকারি গাড়ি থাকা ও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আসা প্রসঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এটা আমার নলেজে নাই। আর গাড়ি নিয়ে আসে নাই। গাড়ি আমরা রিকুইজিশন করছি। আপনারা যেসব দেখেছেন, ছবি তুলেছেন, সেসব আমরা রিকুইজিশন করে এখানে রেখেছি। নির্বাচনী কাজে সব গাড়ি আমাদের রিকুইজিশন করা। এসব গাড়িই আপনার দেখেছেন, ছবি তুলেছেন।’