থানা, আদালত আর কারাগারের চক্কর

>
  • পুরোনো–গায়েবিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি বিএনপির বহু প্রার্থী
  • গ্রেপ্তার হচ্ছেন কেউ, জামিন চাইতে গিয়ে কারাগারে যেতে হচ্ছে
  • জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় খায়রুল কবির খোকন কারাগারে
  • যশোর-২ আসনের প্রার্থী সাবিরার দণ্ড ও সাজা স্থগিত

সারা দেশে এখন নির্বাচনী হাওয়া। তবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখনো আদালত, থানা আর কারাগারেই চক্কর কাটছেন। দলের টিকিট পেলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তায় বিএনপির বহু নেতা।

তাঁদের কেউ কেউ সম্প্রতি দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে। আবার একই মামলায় অন্যদের জামিন হলেও বিএনপির প্রার্থীদের কারাগারে যাওয়ার ঘটনাও আছে। কেউ পুরোনো নাশকতার বা দুর্নীতির মামলার দণ্ড নিয়ে কারাগারে। আর অনেকে উচ্চ আদালতে যাচ্ছেন সাজা স্থগিতের আশায়।

এখনো পর্যন্ত একজন ছাড়া বাকিরা দণ্ড ও সাজা স্থগিতের জন্য উচ্চ আদালতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার যশোর-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবিরা সুলতানার দণ্ড ও সাজা স্থগিতের আবেদন মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এর ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে সাবিরার কোনো আইনগত বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম। সাবিরা যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান।

এর আগে ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ দুর্নীতির পৃথক পাঁচ মামলায় নিম্ন আদালতের দেওয়া দণ্ড ও সাজা স্থগিত চেয়ে বিএনপির পাঁচ নেতার আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন। যেখানে পাঁচ নেতার ৮ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ছিল। ওই পাঁচজন হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, ড্যাব নেতা চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, সাবেক সাংসদ ওয়াদুদ ভূঁইয়া, আবদুল ওহাব ও মশিউর রহমান। দ্বৈত বেঞ্চের ওই আদেশে বলা হয়, সংবিধান অনুসারে দুই বছর বা তার বেশি সাজার রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

গতকাল সাবিরার সাজা ও দণ্ড স্থগিতের পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ওই আবেদনের (সাবিরা সুলতানা) কপি সংগ্রহের জন্য পাঠানো হয়েছে। হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিপরীতে যদি কোনো একক বেঞ্চে এমন আদেশ হয়, তাহলে অবশ্যই আপিল বিভাগে যেতে হবে।

একই মামলায় অন্যদের জামিন
এদিকে নরসিংদীতে পুলিশের করা মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চেয়েছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সদর আসনে বিএনপির মনোনীত একক প্রার্থী খায়রুল কবির খোকন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে খায়রুলকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ২৭ জন বিএনপি নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে বিশেষ নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ। এজাহারে খায়রুলের নাম ছিল না। ২৫ নভেম্বর এই মামলায় ২৭৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেই অভিযোগপত্রের ৮৭ নম্বর আসামি তিনি। গতকাল বিকেলে খায়রুলসহ জেলা যুবদলের সভাপতি মোহসীন হোসাইন ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের জেলা সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির সেই মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। আদালত বাকি দুজনের জামিন মঞ্জুর করলেও খায়রুলের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান।

খায়রুল কবিরের আইনজীবী আবদুল বাছেদ ভূঁইয়ার অভিযোগ, খায়রুল কবিরকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব করা হচ্ছে।

রিমান্ডে ঢাকা-৭–এর প্রার্থী
মনোনয়ন জমা দিয়ে ফেরার পথেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা-৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী মোশাররফ হোসেন ওরফে খোকন। গত সেপ্টেম্বরে দায়ের হওয়া একটি নাশকতার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে লালবাগ থানার পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) মোশাররফকে দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন।

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে মোশাররফকে। আদালত সূত্র বলছে, মামলায় মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। মোশাররফের ঘনিষ্ঠজন হায়দার আলী বলেন, বুধবার ঢাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে শাহবাগে আসার পর এটিএম বুথে টাকা তোলার জন্য গাড়ি থেকে নামেন মোশাররফ। তখন সাদাপোশাক পরা কয়েকজন লোক তাঁকে তুলে নিয়ে যান।

জামিন নামঞ্জুর, কারাগারে মাগুরা-১–এর প্রার্থী
মাগুরা-১ আসনের বিএনপির প্রার্থী মনোয়ার হোসেন খানকে ২০১৫ সালের একটি মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। ২০১৫ সালে ২১ মার্চ দেশব্যাপী ২০–দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে সদর উপজেলায় একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় পাঁচ বালুশ্রমিক নিহত হন। ওই ঘটনায় হওয়া মামলার দুই নম্বর আসামি বিএনপির এই নেতা।

আলোচিত ওই মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মনোয়ার দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে ছিলেন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। নির্বাচন করতে সম্প্রতি দেশে এসে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন নেন তিনি। পরে সেই জামিন বাতিল হওয়ায় গতকাল মাগুরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।

খোকার ছেলে–মেয়েকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ
ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ও মেয়েকে চার সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। খোকার ছেলে ইসরাখ হোসেন ঢাকা-৬ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন।

সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল না করায় দুদকের করা পৃথক মামলায় আগাম জামিন চেয়ে তাদের করা পৃথক আবেদন নিষ্পত্তি করে গতকাল একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতে হাজির হয়ে ইসরাখ ও তাঁর বোন সারিকা সাদেক আইনজীবীর মাধ্যমে আগাম জামিনের আরজি জানিয়েছিলেন।

জামিন পেলেও মুক্তি পাননি
রাজবাড়ীতে আদালত থেকে জামিন পেলেও কারাগার থেকে মুক্তি পাননি বিএনপির ২৯ জন নেতা-কর্মী। গত মঙ্গলবার একটি মামলায় আদালত তাঁদের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করার পর তাঁদের আরও তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। এই ২৯ জনের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি রকিবুল ইসলাম, থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কে এম সবুর শাহীন, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আহসানুল করিম প্রমুখ।

(তথ্য দিয়েছেন নরসিংদী, মাগুরা ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি)