'যে রাজা গদিত যাউক সমস্যা নাই'

ছোটখাটো চা-স্টল। দুই দিক খোলা। দু-তিনটা পুরোনো বেঞ্চ ও টেবিল পাতা। বিক্ষিপ্তভাবে দু-চারজন ক্রেতা আড্ডার ঢঙে বসে আছেন। কাপের মধ্যে চায়ে বনরুটি ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন একজন। নাম ছুরুক মিয়া। পেশায় ঠেলাচালক। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঠেলাগাড়ি চালিয়েছেন। ক্লান্তি ও ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে এই কম দামের স্টলটি বেছে নিয়েছেন তিনি।

পাশে বসতেই কিছুটা নড়েচড়ে উঠলেন ছুরুক মিয়া। কিছুটা কৌতূহলী চোখে তাকালেন। কথা বলতে চাইলে আরও জড়সড় হয়ে গেলেন। কথা বলতে যেন দ্বিধাগ্রস্ত। কিছুটা সময় এলোমেলো কথাবার্তার পর একপর্যায়ে সহজ হয়ে ওঠেন। ভোটের কথা তুলতেই ছোট ছোট উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলেন।

আলাপ চলতে থাকল। আরও লোকজন জমে গেল। অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে ভোটের নানা বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করলেন। ছুরুক মিয়াও যেন তাঁর স্বাভাবিক স্বর ফিরে পেলেন। বললেন, ‘আমরা অইলাম গরিব মানুষ। ভোট নিয়া চিন্তা করার সময় আছেনি। সুষ্ঠু নির্বাচন অইলে যে রাজা (সরকার) গদিত যাউক, আমরার কোনো সমস্যা নাই। গরিব মানুষ। সরকার থাকি কিছু পাইলে পাইলাম। না পাইলে নাই। এতা লইয়া আমরার কোনো চিন্তা নাই।’ তবে ছুরুক মিয়া নিজের ভোটটাকে নষ্ট করবেন না। ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোট যেতে বদ্ধপরিকর তিনি।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা সদরের রেলস্টেশন এলাকায় ছুরুক মিয়ার সঙ্গে এই আলাপচারিতা। রেললাইন বন্ধ থাকায় স্টেশনটি এখন নিথর। ক্ষুদ্র চা স্টলের মালিক সফিক উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আসলে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। মাইর-মারকা (ঝগড়া-বিবাদ) না করি যাতে সুন্দর ভোট অয়।’

কাছেই উপজেলা সদরের হাজীগঞ্জ বাজার। অনেক রকম দোকান সেখানে। ক্রেতারা যে যার মতো আসছেন। কেনাকাটা করে চলে যাচ্ছেন। কেউ দরদামে পোষাচ্ছে না বলে ফিরে যাচ্ছেন। তবে তখনো বাজার পুরোদমে জমে ওঠেনি। সন্ধ্যার দিকে হয়তো ভিড় বাড়বে।

তরুণ মাছ বিক্রেতা আবদুর রহিম এবারই প্রথম ভোটার হয়েছেন। ভোট দেওয়া নিয়ে তাঁর অনেক উচ্ছ্বাস। বললেন, ‘আমার ধারণা, সুষ্ঠুভাবে ভোট অইবো। সবারই অধিকার আছে ভোট দেওয়ার।’

ভোট নিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষার কথা বললেন বড়লেখা উপজেলার সুরইকান্দি গ্রামের তরুণ আমানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরে মানুষ ভোটবঞ্চিত। মানুষ ভোট দিতে চায়। সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। মানুষের মধ্যে ভোটের ক্ষুধা আছে। তবে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কম।’

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট নিয়ে সংশয় আছে আরও অনেকের। ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন আহমদ বললেন, ‘ভোট সঠিকভাবে হবে কি না, এ নিয়ে আমরা সন্দিহান। বিরোধী দলের সঙ্গে যে আচরণ করছে নির্বাচন কমিশন, তাতে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।’

একই রকম সন্দেহ প্রকাশ করলেন ব্যবসায়ী রুহেল আহমদও। বললেন, সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় লাগে। আগে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এবার তো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন।

সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে অনেকের সন্দেহ থাকলেও ভালো একটা নির্বাচনের আশায় প্রায় সবাই। হাজীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী সেলিম আহমদ বলেন, ‘আমরা চাই ভালো নির্বাচন অইতো। যাতে কোনো মারদাঙ্গা না অয়। তবে কী রকম নির্বাচন অইবো ওখনো বোঝা যায় না।’ আরেক ব্যবসায়ী জাবের আহমদ বলেন, ‘সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। দীর্ঘদিন ধরে এই আশায় আছি। সুষ্ঠু নির্বাচনের আলামত আছে।’

বড়লেখার হাজীগঞ্জ বাজারসংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ২৫-৩০ জন মানুষের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়। অনেকেই নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চান না। নির্বাচনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। অনেকে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকের মধ্যে ভালো ভোট হবে, এই আশাবাদও আছে। তবে সবার প্রত্যাশা একটাই—অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন। যাতে কোনো রকম বিশৃঙ্খলা না হয়। যার ভোট তিনি নিজেই দিতে পারেন। ফল যা–ই হোক সবাই যেন মেনে নেন। শেষমেশ শান্তিশৃঙ্খলার পক্ষেই মানুষের অবস্থান।