এইডসের ঝুঁকিপূর্ণদের জন্য সেবা বাড়াতে হবে

৩০ বছর বয়সী হালিমার (ছদ্ম নাম) জীবনের ১৮ বছরই কেটেছে রাস্তায় যৌন কাজ করে। ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর একটি ভবঘুরে কেন্দ্রে জীবন শুরু হয়েছিল তার। নির্যাতনের কারণে কিশোরী হওয়ার আগেই সেখান থেকে পালিয়েছিলেন হালিমা। বেঁচে থাকার তাগিদে যৌন কাজকে পেশা হিসেবে নেন। বিয়ে করেছিলেন। যৌন পেশার কথা স্বামী জানার পর অত্যাচারে সেখানে টিকতে পারেননি। বছরখানেক আগে গৃহকর্মী হিসেবে জর্ডান যান। সেখানে বেতন না পাওয়াসহ বিভিন্ন নির্যাতনে পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।

হালিমা সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত রাজধানীর একটি এইচআইভি ও এইডস সেবাকেন্দ্রে কাজ পেয়েছেন। তিনি অন্য নারী যৌনকর্মীদের এইচআইভি ও এইডস বিষয়ে সচেতন করেন। হালিমার ভাষায়, ‘ছোটবেলায় বুঝতাম না, খদ্দের কনডম ব্যবহার করত না। এই জীবনে কতবার যে যৌন রোগে ভুগছি। ভাগ্য ভালো এইডস রোগ হয় নাই। এ রোগ হওনের সব রাস্তাই খোলা আছিল।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত রাজধানীর একটি এইচআইভি ও এইডস সেবাকেন্দ্রে কয়েকজন। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত রাজধানীর একটি এইচআইভি ও এইডস সেবাকেন্দ্রে কয়েকজন। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

কথায় কথায় হালিমা বললেন, যৌনকর্মীরা এখন কিছুটা সচেতন হয়েছেন। কনডম ছাড়া যৌনকাজ করেন চায় না। খদ্দেরও আগের চেয়ে কিছুটা সচেতন। এই বাস্তবতায় ১ ডিসেম্বর শনিবার বাংলাদেশেও পালিত হয় বিশ্ব এইডস দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘এইচআইভি পরীক্ষা করুন, নিজেকে জানুন’।

গত বুধবার সেভ দ্য চিলড্রেনের অন্য একটি সেবাকেন্দ্রে গিয়ে শিরায় মাদকগ্রহণকারী কয়েকজন এইডস রোগীর সঙ্গে কথা হয়। বর্তমানে এইডসের ক্ষেত্রে সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে শিরায় মাদকগ্রহণকারীরা। ২০ বছর আগে এইডস শনাক্ত হওয়া একজন বললেন, এইডসের কথা শুধু পরিবার জানে। দুই মেয়ের পড়াশোনা, বিয়ে, বাড়িভাড়া পেতে সমস্যা হতে পারে, এই আশঙ্কায় রোগের কথা গোপন রেখেছেন।
ছয় মাস আগে এইডস শনাক্ত হওয়া একজন বললেন, ২০ বছরের বেশি সময় তিনি শিরায় মাদক নেন। একই সিরিঞ্জ একাধিকজন ব্যবহার করেন। মাদক নেওয়ার কারণে ২০০৮ সালে স্ত্রী, সন্তান তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। এক নারী জানালেন, তাঁর স্বামীও এইডস রোগী। শিরায় মাদকগ্রহণকারীরা বলেছেন, সরকার যেন তাঁদের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৪৫৫ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ২২ জন। দেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের অনুমিত সংখ্যা ১৩ হাজার। তাদের সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ২৬৫ জনকে সরকার বিনা মূল্যে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) দিয়েছে।

মাদকগ্রহণকারী এইডস রোগী সেবাকেন্দ্রে ওষুধ নিচ্ছেন। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মাদকগ্রহণকারী এইডস রোগী সেবাকেন্দ্রে ওষুধ নিচ্ছেন। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী: শিরায় মাদকগ্রহণকারী, নারী যৌনকর্মী, সমকামী, পুরুষ যৌনকর্মী এবং হিজড়া জনগোষ্ঠী ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। সরকারের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির পাশাপাশি সেভ দ্য চিলড্রেন এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভির প্রাদুর্ভাব বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫-২০১৬ সালের সরকারের জরিপ বলছে, দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ২৬০ জন। সুই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ৬৭ জন।

সেভ দ্য চিলড্রেন সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে যৌনকর্মীর জন্য ১২টি জেলায় এবং মাদকগ্রহণকারীদের ৬টি জেলায় সেবা দিচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ঘনত্ব অনুযায়ী অগ্রাধিকার জেলায় যৌনকর্মীদের জন্য ২৯টি এবং মাদক গ্রহণকারীদের জন্য ২১টি ড্রপ-ইন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। এই কাজে কেয়ার বাংলাদেশ, আশার আলো সোসাইটি, মুক্ত আকাশ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংগঠন সহায়তা করছে।

রাজধানীর চানখাঁরপুলে শিরায় মাদকগ্রহণকারীদের সেবা প্রদান কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, এইডস আক্রান্ত এবং মাদকসেবীদের সুই-সিরিঞ্জ নির্ভরতা বন্ধের জন্য মুখে সেবনযোগ্য বিকল্প থেরাপি (ওএসটি) সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে কেন্দ্রে কর্মরত লোকজন জানালেন, মাদকসেবীদের সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়ছে।

রাজধানীর শ্যামলীর একটি ড্রপ ইন সেন্টারে নারী যৌনকর্মীদের বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। সেন্টারে যৌনকর্মীরা এইচআইভি/এইডস নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেন। কেন্দ্র থেকে এইচআইভি পরীক্ষা এবং বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে কনডম কিনতে পারেন তাঁরা। যৌনকর্মীদের দাবি, সরকার যেন তাঁদের ব্যাপারে গুরুত্ব বাড়ায়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের নারী যৌনকর্মীদের জন্য পরিচালিত এইচআইভি/এইডস কর্মসূচির ব্যবস্থাপক সালিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, নারী যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডম ব্যবহারের হার আগের তুলনায় বেড়েছে। খদ্দেরদের অসহযোগিতাসহ বিভিন্ন কারণে কনডম ব্যবহারের হার কম। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

নতুন উদ্বেগ: সরকারের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির ব্যবস্থাপক বেলাল হোসেন বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকেরা এইডসের ক্ষেত্রে নতুন উদ্বেগ তৈরি করছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি সম্মতি না দিলে এইডস পরীক্ষা করা যায় না। এ কারণে বিদেশ ফেরত শ্রমিক ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শনাক্তকরণের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তথ্য বলছে, গত আগস্ট পর্যন্ত এইডস ভাইরাসে আক্রান্ত ২৫৮ জন রোহিঙ্গা শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২১১ জন। ১৪ জন রোহিঙ্গা মারা গেছেন। অন্যদিকে সরকারের গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এইচআইভি-আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৩১ শতাংশই ছিলেন বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিক।
বেলাল হোসেন জানালেন, বিদেশ যাওয়ার আগে শ্রমিকদের এইচআইভি পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে ফেরত আসার সময় বিমানবন্দরে এই শ্রমিকদের রক্ত পরীক্ষার কোনো কার্যক্রম নেই।
বাংলাদেশি মহিলা অভিবাসী শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকদের একটি ডেটাবেইস তৈরি করতে হবে। সরকারকে গোপনীয়তা রক্ষা করেই শ্রমিকের চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।