হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে সেই তোফা-তহুরা

তোফা ও তহুরাকে এখন একসঙ্গে করাই মুশকিল। একজন দৌড়ায় তো আরেকজন হাঁটে। একজন মায়ের কোলে তো আরেকজন বাবার কোলে। একজন খিলখিল করে হাসে তো, আরেকজনের গাল ফুলিয়ে কান্না, নয়তো অভিমান। অথচ এই তোফা ও তহুরা একজন আরেকজনের শরীরের সঙ্গে জোড়া লাগানো অবস্থায় জন্ম নিয়েছিল। জন্মের পর এভাবেই ছিল ১০ মাস।

গত বছরের ১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ২০ থেকে ২২ জন অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক ৯ ঘণ্টা যুদ্ধ করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের আলাদা করেন। এখন এই দুই বোনের বয়স দুই বছর দুই মাস।

হাসপাতালের বারান্দায় খেলায় মশগুল তোফা ও তহুরা। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
হাসপাতালের বারান্দায় খেলায় মশগুল তোফা ও তহুরা। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

জন্মের পর আট দিন বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক সাহনূর ইসলামের অধীনে ভর্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে এ হাসপাতালে। দুজনের পেটে অস্ত্রোপচার করে পায়খানার রাস্তা তৈরি, অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা, আলাদা পায়খানা ও মাসিকের রাস্তা তৈরি, পেটের পায়খানার রাস্তা বন্ধ করাসহ এ পর্যন্ত মোট চারটি অস্ত্রোপচার শেষে তোফা ও তহুরা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আজ সোমবার রাতে তারা হাসিমুখে মা শাহিদা বেগমের সঙ্গে গাইবান্ধায় বাড়ি ফিরছে।

বাবা রাজু মিয়ার কোলে উচ্ছ্বসিত সে। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
বাবা রাজু মিয়ার কোলে উচ্ছ্বসিত সে। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

আজ দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, তোফা ও তহুরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে বলে শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা দারুণ খুশি। তাঁরা সবাই মিলে ঘটা করে তোফা ও তহুরা সঙ্গে ছবি তোলেন। এ ছবি তোলায় অংশ নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিনও। পরিচালক তোফা ও তহুরার বাবা রাজু মিয়ার জন্য হাসপাতালের বাগানে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাই দুই মেয়ের সঙ্গে রাজু মিয়া আপাতত বাড়ি যেতে পারছেন না।

এ যেন বিদায় সম্ভাষণ! বাবা-মায়ের কোলে তোফা ও তহুরা। সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিনসহ চিকিৎসকেরা। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
এ যেন বিদায় সম্ভাষণ! বাবা-মায়ের কোলে তোফা ও তহুরা। সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিনসহ চিকিৎসকেরা। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

আর তোফা-তহুরাকে দেখে কে বলবে তারা পিঠের থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জন্মেছিল। খেলনা হাঁস নিয়ে হাসপাতালের বারান্দা কাঁপাচ্ছে! আশপাশের রোগীর স্বজনেরা একবার করে হলেও গাল টিপে আদর করছেন, নয়তো ওদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিচ্ছেন।

তোফা ও তহুরার মা শাহিদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো দিন চিন্তা করি নাই আমার মেয়েরা হাঁটতে পারবে। এখন ওরা হাঁটে, দৌড়ায়। হাসিমুখে দুই মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতাছি, আপনারা সবাই আমার দুই মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।’

অস্ত্রোপচারের আগে তোফা-তহুরা। তারা পিঠ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত পরস্পর সংযুক্ত ছিল। ছবি: মানসুরা হোসাইন
অস্ত্রোপচারের আগে তোফা-তহুরা। তারা পিঠ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত পরস্পর সংযুক্ত ছিল। ছবি: মানসুরা হোসাইন

অধ্যাপক সাহনূর ইসলাম জানালেন, তোফা ও তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’। বাংলাদেশে ‘পাইগোপেগাস’ শিশু আলাদা করার ঘটনা এটি প্রথম। এর আগে অন্যান্য হাসপাতালে অন্য ধরনের জোড়া লাগানো শিশুদের অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয়। শুধু অস্ত্রোপচার নয়, তারা এখন অন্যান্য আট দশটি মেয়ে শিশুর মতোই। ভবিষ্যতে বিয়ে করা, সন্তান জন্ম দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক ভাবেই হবে। তবে ওদের ফলোআপে থাকতে হবে, যাতে যে কোনো সমস্যা হলেই তা দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

নানা ও মায়ের হাত ধরে হাঁটাহাঁটিতে ব্যস্ত তোফা-তহুরা। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
নানা ও মায়ের হাত ধরে হাঁটাহাঁটিতে ব্যস্ত তোফা-তহুরা। ঢাকা মেডিকেল, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

অধ্যাপক সাহনূর ইসলাম এই দুই শিশু ও তার বাবা মায়ের পুনর্বাসনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা যাতে করা হয়, সে আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আশরাফ উল হক বলেন, ‘তোফা ও তহুরার মেরুদণ্ডের হাড়, মেরুমজ্জা একসঙ্গে লাগানো ছিল। আলাদা করার ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি ছিল। চারটি অস্ত্রোপচারের পর তারা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আজ ওরা হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে, আর আমাদের চিকিৎসকদের কাছে মনে হচ্ছে আজ ঈদের দিন।’