নেতারা এবার শেয়ারবাজারে

>

*প্রার্থীদের দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ
*প্রার্থীদের বেশি আগ্রহ শেয়ারবাজারে ও সঞ্চয়পত্রে
*রাজনীতিকদের এই দুই খাতে বিপুল বিনিয়োগ

শেয়ারবাজারের দুই কেলেঙ্কারিই ছিল আওয়ামী লীগের দুই আমলে। সাধারণ অনেক বিনিয়োগকারী এখনো বিপুল পরিমাণ লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ভরসা ফিরে পায়নি অনেকে। কিন্তু নেতাদের ভরসা আছে পূর্ণমাত্রায়। নেতাদের আগ্রহ এখন শেয়ারবাজার আর সঞ্চয়পত্রে। এমনকি নগদ ও ব্যাংকে রাখা টাকা, বাড়ি-গাড়ি ও সোনা-দানার চেয়েও শেয়ারবাজার এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিল করা প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণে এই চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।

অনেকে গত কয়েক বছরে নানাভাবে বিপুল আয় ও সম্পদ অর্জন করেছেন। এই সমস্ত অর্থের বড় অংশই গেছে শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্রে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ কারণে সরকার উদ্যোগ নিয়েও সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমাতে পারেনি। শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা যদি শেয়ারবাজারে বিপুল বিনিয়োগ করে থাকেন, আর সেই বিনিয়োগ যদি হয় ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পরে, তাহলে আমি একে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য তাঁরা শেয়ারবাজারকেই কেন বেছে নিলেন, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত মন্তব্য করা মুশকিল।’
শেয়ারবাজারে রাজনীতিবিদদের কালোটাকা ঢুকেছে বলে মনে হয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক সিদ্দিকী বলেন, ‘ঢুকতেই পারে। তবে সম্ভাবনা কম। কারণ, নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা তথ্য-উপাত্ত নিশ্চয়ই তাঁরা আয়কর বিবরণীতেও দেখিয়েছেন। আয়কর বিবরণীতে দেখানো না থাকলে অবশ্য বড় একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এবার আমার প্রশ্ন, যে প্রশ্ন থেকে যায়, সে প্রশ্নের জবাব দেবে কে?’

এইচ এম এরশাদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সালমান এফ রহমান, মির্জা আব্বাস, শাহরিয়ার আলম, বি এইচ হারুন, রুহুল আমিন হাওলাদার, হাজি মো. সেলিম
এইচ এম এরশাদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সালমান এফ রহমান, মির্জা আব্বাস, শাহরিয়ার আলম, বি এইচ হারুন, রুহুল আমিন হাওলাদার, হাজি মো. সেলিম

আওয়ামী লীগ
হলফনামায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকা-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়—এমন সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে ২৫০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তাঁর নগদ টাকা ২ কোটি ১০ লাখ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এমনিতেই শেয়ারবাজারের অন্যতম আলোচিত নাম সালমান এফ রহমান। শেয়ারবাজারের দুই কেলেঙ্কারির সময়েই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল।

ঢাকা-১০ আসনে মনোনয়ন পাওয়া শেখ ফজলে নূর তাপসের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ৪৩ কোটি ২৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। শেয়ারবাজার থেকে তাঁর আয় ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। তাঁর নগদ আছে ৬ কোটি টাকার বেশি এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা টাকা ৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে ফজলে নূরের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ছিল ৩২ কোটি ১৪ লাখ টাকার এবং স্ত্রীসহ দুজনের সঞ্চয়পত্র ছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকার।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, তাঁর স্ত্রী ও নির্ভরশীল পুত্রের নামে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বা তালিকাভুক্ত নয়—এমন কোম্পানিতে ৬৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। তিনজনের ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা রয়েছে ব্যাংকে ও নগদে। ২০১৩ সালে শাহরিয়ার আলমের শেয়ারবাজারে কোনো বিনিয়োগ ছিল না।

মাদারীপুর-১ থেকে মনোনয়ন পাওয়া নূর-ই-আলম চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রীর একটি ব্যাংক ও একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ আছে ৩৭ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে অতালিকাভুক্ত কোম্পানিতে তাঁদের বিনিয়োগ ছিল ২১ কোটি টাকা।

ঢাকা-১১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া এ কে এম রহমত উল্লাহ ও তাঁর স্ত্রীর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ প্রায় ২৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তাঁর নিজের নামে ছিল ৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ও স্ত্রীর নামে ২ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার।

জামালপুর-৩ আসনে মনোনয়ন পাওয়া বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও তাঁর স্ত্রীর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের তুলনায় তাঁদের বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মোট আয়ের মধ্যে শেয়ারবাজার থেকেই বেশি, ৬৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে তাঁর কোনো বিনিয়োগ ছিল না। ৯ কোটি ৭ লাখ টাকার বিনিয়োগ ছিল সঞ্চয়পত্রে।

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বা তালিকাভুক্ত নয়—এমন বিনিয়োগ ৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর এ খাতে বিনিয়োগ আরও বেশি, ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। স্থায়ী আমানত বা সঞ্চয়পত্রে অবশ্য দুজনের বিনিয়োগ প্রায় ৪৯ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তাঁর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ছিল ১৪ কোটি ২০ লাখ ও স্ত্রীর নামে ১৭ কোটি ২১ লাখ টাকার। সেবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ছিল ৩৮ কোটি টাকা।
ঝালকাঠি-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া বজলুল হক হারুন ও তাঁর স্ত্রী মনিরা হারুনের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ২২ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্রে ৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ছিল ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্র ছিল ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার।

সাবের হোসেন চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর ১৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বা তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিতে। ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে তাঁদের বিনিয়োগ ছিল ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর শেয়ারবাজারে ৬ কোটি ২৫ লাখ এবং সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানত রয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকার। ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে তাঁর বিনিয়োগ ছিল ১ কোটি ৪ লাখ টাকা আর সঞ্চয়পত্র ১ কোটি ৫১ লাখ টাকার।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ হ ম রুহুল হক ও তাঁর স্ত্রীর শেয়ারবাজারে ৩ কোটি ৬০ লাখ ও সঞ্চয়পত্রে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ রয়েছে। ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী হাজি মো. সেলিম ও তাঁর স্ত্রীর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ৬২ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

বিএনপি ও জাতীয় পার্টি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের (ঢাকা-৮) নামে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ২৯ কোটি ৩৯ লাখ ৪৩ হাজার ৪৮৫ টাকা। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের নামে শেয়ারবাজারে ১০ কোটি ৪ লাখ টাকা ও সঞ্চয়পত্রে রয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ টাকার বিনিয়োগ। এর বাইরে মির্জা আব্বাসের হাতে নগদ ৩ কোটি ৬২ লাখ এবং আফরোজা আব্বাসের হাতে নগদ ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা রয়েছে।
নোয়াখালী-৫ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া মওদুদ আহমদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ৩৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। তবে প্রায় ১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা আছে তাঁর।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য চট্টগ্রাম-১১ আসনের প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ১ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র আছে ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ও ব্যাংকের আছে ১০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

শেয়ারবাজারে চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের বিনিয়োগ আছে ৩৯ কোটি ৬৯ লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ টাকা। আর হাতে নগদ রয়েছে আড়াই কোটি টাকা এবং ব্যাংকে জমা আছে ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।

ঢাকা-৪ আসন থেকে প্রার্থী হতে চাওয়া বিএনপির সাবেক সাংসদ সালাহ উদ্দিন আহমেদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা আর ব্যাংক হিসাবে জমা রয়েছে ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। ব্যাংকে জমা রয়েছে ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬ টাকা। এরশাদের হাতে নগদ রয়েছে ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯৯৮ টাকা, তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদের হাতে নগদ রয়েছে ২৬ কোটি ২০ লাখ ২৯ হাজার ২৩৩ টাকা। সঞ্চয়পত্রে এরশাদের বিনিয়োগ আছে ৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা ও রওশন এরশাদের ৮ কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার ১৭ টাকা। ২০১৩ সালে এরশাদের শেয়ার ছিল ৪০ কোটি টাকার এবং সঞ্চয়পত্র ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার।

জাতীয় পার্টির সদ্য অপসারিত মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের নিজের নামে ৭ কোটি ৭০ লাখ ও স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন। সঞ্চয়পত্রে তাঁর নিজের নামে বিনিয়োগ ৫ কোটি টাকা। ১৩ কোটি টাকা নগদ রয়েছে তাঁর। ২০১৩ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল ৭ কোটি টাকা, স্ত্রীর ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্রে কোনো বিনিয়োগ ছিল না। তবে ব্যাংকে ছিল ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় অনেক জায়গায় রাখা টাকার কিছু অংশ তাঁরা শেয়ারবাজারে রেখেছেন। আবার হলফনামায় তাঁরা সম্পদের কতটা ঘোষণা দিচ্ছেন, তা কিন্তু আর যাচাই করা হচ্ছে না। যাচাই হলে তাঁদের প্রকৃত সম্পদের চিত্র উঠে আসত।’

সঞ্চয়পত্র বিষয়ে আহসান মনসুর বলেন, সরকার গরিবের কথা বললেও সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মচারীরা। এবারের হলফনামায় অন্তত রাজনীতিবিদদেরটা জানা গেল। এ জন্যই সঞ্চয়পত্রের সুদের হারকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয় না।