ভোট এলেই নাটক জমে জাপায়

এইচ এম এরশাদ। ফাইল ছবি
এইচ এম এরশাদ। ফাইল ছবি
>
  • এরশাদের অসুস্থতা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা কথা
  • ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি ঝুলে আছে
  • মহাসচিব বদলানোর ঘটনায় দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি
  • এরশাদ–হাওলাদারের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ

 জাতীয় সংসদের ভোট এলেই নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। গতবার মনোনয়নপত্র দাখিলের পর শেষ সময়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর। পাঁচ বছরের মাথায় ঠিক একই দিনে, গতকাল ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই তিনি দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দিলেন। যখন এরশাদ ও হাওলাদার—দুজনের বিরুদ্ধেই মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন দলের নেতাদের অনেকে।

একাদশ সংসদ নি​র্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন নিয়ে দর-কষাকষির মধ্যেই অসুস্থ হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) যান জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। অসুস্থতা নিয়েও দলের ভেতরে-বাইরে নানা কথা আছে। তিন দিন আগে তিনি বাসায় ফিরেছেন। এখনো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি ঝুলে আছে। এরই মধ্যে মহাসচিব বদলানোর ঘটনায় দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

এরশাদ গতকাল দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমানকে (রাঙ্গা) দেওয়া এক চিঠিতে বলেন, ‘আপনাকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হলো। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যের পাশাপাশি আপনি এই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন।’ দলের গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা মোতাবেক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে চিঠিতে বলা হয়। মসিউর রহমান গতকালই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বনানী কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

জাপার উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, গত ২৮ নভেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখের পর থেকেই জাপার মনোনয়ন পাননি, এমন অনেক নেতা দলীয় কার্যালয়ে এসে প্রতিক্রিয়া দেখান। মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সে খবর যেভাবে প্রকাশ হচ্ছিল, তাতে মহাসচিবকে পরিবর্তন করা ছাড়া এরশাদের উপায় ছিল না।

জানা গেছে, অন্তত ১০ নেতা জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন। কয়েকজন নেতা পদত্যাগও করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা-১ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন না পেয়ে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান জাপার সাংসদ সালমা ইসলাম। এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে আলোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানকে।

দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রশীদ সরকার, কেন্দ্রীয় নেতা রিন্টু আনোয়ার ও রোকন উদ্দিন পদত্যাগ করেন। নীলফামারী-৪ আসনের দলীয় সাংসদ শওকত চৌধুরী, দিনাজপুর-৫ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী মো. সোলায়মান সামি, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের শেখ শরিফুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের কাজী মামুনুর রশীদ ও জয়পুরহাট-২ আসনে আবুল কাশেমসহ আরও কয়েকজন গণমাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর জাপার অন্তত তিনজন নেতার বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে মহাজোটের মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তাঁদের মধ্যে রুহুল আমিন হাওলাদারের পাশাপাশি দলীয় প্রধান এরশাদ এবং তাঁর রাজনৈতিক সচিব সুনীল শুভ রায় অন্যতম। এখন রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে এরশাদ নিজের দায় এড়ান বলে দলে আলোচনা আছে।

রুহুল আমিন হাওলাদার মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে কলঙ্ক লেপনের জন্য ষড়যন্ত্রমূলক এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে। যাঁরা এসব করছেন, সময়ের ব্যবধানে তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের ভুল বুঝতে পারবেন।

এ বিষয়ে গতকাল বিকেলে জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নতুন মহাসচিব মসিউর রহমান। রুহুল আমিন হাওলাদার মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মসিউর রহমান বলেন, ‘তিনি (হাওলাদার) তো ঋণখেলাপি হয়েছেন। এ ধরনের কাজ করলে উনি ঋণখেলাপি হতেন না।’

তবে মসিউর এ-ও বলেন, দলের মধ্যে কেউ মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে দলীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যাঁরা মনোনয়ন কিনেছেন, তাঁরা যদি অভিযোগ করেন, প্রয়োজনে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

মহাসচিব বদলের পর জাপায় এমন আলোচনা হচ্ছে যে নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের নানা সন্দেহে আছেন এরশাদ। সে কারণে তাঁর ওপর বাড়তি নজরদারি আছে। এরশাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, এরশাদ এ অবস্থা থেকে ফিরতে চান। সে চিন্তা থেকেই তিনি রুহুল আমিন হাওলাদারকে অব্যাহতি দিয়ে আপাতত এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল নিয়েছেন। কারণ, নবনিযুক্ত মহাসচিব মসিউর রহমান সরকারের কাছে অধিক আস্থাশীল। তিনি সরকারের প্রতিমন্ত্রী।

এ প্রসঙ্গে জাপার শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মসিউর রহমান এই মুহূর্তে হাওলাদারের চেয়ে শক্তিশালী। কারণ, তিনি সরকারে আছেন, সরকারি মহলের সঙ্গে যোগাযোগও ভালো। আবার দলেও তাঁর ভালো অবস্থান আছে।

এর আগে জাপায় টানাপোড়েনের মধ্যে ২০১৩ সালের এপ্রিলে রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিব করেন এরশাদ। তিন বছরের মাথায় ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তাঁকে বাদ দিয়ে আবার হাওলাদারকে মহাসচিব পদে ফিরিয়ে আনেন এরশাদ। তিনি হাওলাদারকে সব সময় সন্তানতুল্য বলতেন। গত সেপ্টেম্বরে দলীয় এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছিলেন, ‘পার্টির নেতারা এখন এক পয়সা সাহায্য করছে না। প্রেসিডিয়াম সদস্যরা পাঁচ হাজার টাকা দেয়। পাঁচ হাজার টাকা তো ভিক্ষুকেও নেয় না। দেওয়ার জন্য আছি আমরা দুজন (হাওলাদারকে দেখিয়ে), আর আছে আমার কর্মীরা।’

হঠাৎ​ পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেয়ারম্যানের চিঠি পেয়েছি এবং আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছি। তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনিই অব্যাহতি দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া দায়িত্ব আমি সততার সঙ্গে পালন করেছি। আমার অব্যাহতিতে যদি দল উপকৃত হয়, আমি খুশি হব।’

অশুভ শক্তির তৎপরতা

গতকাল দায়িত্ব গ্রহণের পর জাপার নতুন মহাসচিব মসিউর রহমান বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গত নির্বাচনের আগেও দলের মধ্যে একটি ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে জাতীয় পার্টি প্রত্যাশিত ফল পায়নি। এবারও নির্বাচনের আগে একটি অশুভ শক্তির তৎপরতায় স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।

এরশাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে মসিউর রহমান বলেন, ‘চেয়ারম্যানের অবস্থা ভালো। গতকাল রাতেও তাঁর সঙ্গে ছিলাম, সকালে নাশতা করেছি। চিকিৎসার জন্য তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেন। তাঁর রক্তের হিমোগ্লোবিনের সমস্যা আছে।’ তবে দলীয় একটি সূত্র জানায়, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ ডিসেম্বরের আগে এরশাদের বিদেশ যাওয়ার সম্ভাবনা কম।