বিদ্যুতে আলোকিত, মাদকে অন্ধকার

প্রথমবারের মতো সন্দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় সন্দ্বীপের খন্তারহাটে।  ছবি: জুয়েল শীল
প্রথমবারের মতো সন্দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় সন্দ্বীপের খন্তারহাটে। ছবি: জুয়েল শীল

সন্দ্বীপের একেবারে দক্ষিণ–পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে হাত দেখালেন আজিমপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিষ্ণু পদ রায়। বললেন, ‘ওই যে চরের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচটা গরু ঘাস খাচ্ছে, সেখানে আমাদের ঘর ছিল। এর পাশে দুটি নারকেলগাছ দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আমি লাগিয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে সমুদ্রের ভাঙন শুরু হলে আমরা এনামনাহার এলাকায় নতুন করে ঘর তুলি।’ বলতে বলতে কিছুটা জড়িয়ে যাচ্ছিল এই বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের কণ্ঠ।

এরপর হতাশা ফেলে বিষ্ণু পদ বলে উঠলেন, ‘কখনো ভাবিনি, সমুদ্রের প্রায় গিলে ফেলা অংশে আবার চর জাগবে। যেমন কখনো কল্পনা করিনি সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ আসবে।’

দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-৩ আসন। আদমশুমারি অনুযায়ী, ৮০ বর্গমাইল আয়তনের সন্দ্বীপে জনসংখ্যা ৩ লাখ ২০ হাজার ১৬০ জন। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ মাহফুজুর রহমান। অপরদিকে মোস্তফা কামাল পাশার মনোনয়ন বাতিল হওয়ার পরও বিএনপির প্রার্থী আছেন দুজন।

এ উপজেলায় প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে। প্রাথমিকভাবে আড়াই হাজার গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। নির্বাচনে এটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে বলেও মনে করছেন স্থানীয় মানুষজন। তবে এর সঙ্গে হতাশা আর ক্ষোভও আছে তাঁদের।

গত শনি ও রোববার উপজেলা সদর, এনামনাহার, আজিমপুর, বাউরিয়া, নাজিরহাট এলাকার অন্তত ৩০ জন মানুষের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বিদ্যুৎ নিয়ে উচ্ছ্বসিত এই মানুষগুলোর প্রায় সবারই একই কথা, গত কয়েক বছরে উপজেলার সর্বত্র মাদক ছড়িয়েছে। চাইলেই মাদক মিলে এখানে-সেখানে। ক্ষোভ আছে ‘চিরকালীন কষ্ট’—যাতায়াত নিয়ে।

সম্প্রতি কিন্ডারগার্টেন ছাত্র শিশু জারিফকে অপহরণ করা হয়। এর পেছনে ছিল মাদক। অপহরণকারীদের লক্ষ্য ছিল জারিফের পরিবার থেকে মুক্তিপণ আদায় করে সেই টাকা দিয়ে মাদক কেনা।

উপজেলা কমপ্লেক্স এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন হলে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। ভোটের বৈতরণি পার হতে আওয়ামী লীগের অস্ত্র হবে বিদ্যুৎ। আর বিএনপি তুলে ধরবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, এই সময়ে মাদক বেড়ে যাওয়ার কথা।

উপজেলার বিভিন্ন বাজারে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী অফিস খোলা হয়েছে। সাংসদের বাড়ি বাউরিয়া এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যেই পাঁচটি নৌকার তোরণ দেখা গেছে।

পুরো উপজেলার মূল সড়কগুলো ঝকঝকে। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থা কিছুটা খারাপ। এর মধ্যে অবশ্য বেশি খারাপ দেখা গেছে, উপজেলা সদর থেকে রহমতপুর ও আজিমপুর ইউনিয়নে যাওয়ার সড়কগুলো। এখানকার বেশির ভাগ সড়কে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল।

শনিবার দুপুরে আজিমপুরের কাইয়্যাপাড়া এলাকার সড়ক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন এক স্কুলশিক্ষক। সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এ এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া তো একটু কম লাগবেই। কারণ এখানে যে বিএনপির সাবেক সাংসদ মোস্তফা কামালের বাড়ি।’

গত বছরের ২ এপ্রিল সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটের অদূরে নৌকা উল্টে ১৮ জন যাত্রী মারা যান। জাহাজ থেকে নেমে তীরে যাওয়ার পথে উত্তাল ঢেউয়ের মুখে বোট উল্টে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তাই স্থানীয় মানুষদের দীর্ঘদিনে দাবি, কুমিরা ও গুপ্তছড়া ঘাটে ভাসমান জেটি স্থাপনের।

এই উপজেলার বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রবাসী। প্রবাসী আয়ের প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা বেশি এ উপজেলায়। সাধারণ দোকানেও চা, শিঙাড়া বিক্রি হচ্ছে আট টাকা করে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিছুটা কষ্টে আছে।

সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক কামাল উদ্দিন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এখানে যাঁরা বড় লোক তাঁরা বড় লোকই হচ্ছেন। আর যাঁরা গরিব তাঁরা গরিবই থেকে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার ছিল—তা ঠিক আছে। কিন্তু আগে তো বাঁচতে হবে। তাই এবার ভোট হিসাব করেই দেব।’