মুক্তির ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের দুই গান

গৌরীপ্রসন্ন
গৌরীপ্রসন্ন

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রের স্বাপ্নিকদের দুটি গান যেমন অশেষ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস ধরে, তারপরও এবং এখনো, সেই দুটি গানের একটি ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি:/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’। অন্যটি ‘মা গো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা/ প্রতিবাদ করতে জানি।’

এই গান দুটির রচয়িতা বিখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর তাঁর গানও হৃদয় মথিত করেছিল একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিকামী বাঙালিদের। শুধু তখনই নয়, ৪৭ বছর ধরে একই মহিমায় শতসহস্র মুখে গাওয়া হচ্ছে এই গান। হয়ে উঠেছে কালজয়ী।

প্রথম গানটি তিনি লিখেছিলেন একটা চায়ের দোকানে বসে। লেখার পর কাগজটি তুলে দিয়েছিলেন সুরকার অংশুমান রায়ের হাতে। গানটি পেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুর করে ফেলেছিলেন অংশুমান রায়। সুর শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তিনি গৌরীপ্রসন্নকে বলেছিলেন, ‘দাদা, এ গান আমিই গাইব।’ গানটি প্রচারিত হয় ১৯৭১ সালের একেবারে শুরুতেই, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। এরপরের ঘটনা তো ইতিহাস!

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা দ্বিতীয় গানটি ‘মাগো ভাবনা কেন’র সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গেয়েও ছিলেন তিনি। এই দুই গানের বাঁধনে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে যায়। তিনি পৌঁছে যান আমাদের প্রাত্যহিক প্রতিরোধের আঙিনায়ও।

আসলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতবর্ষের নৈতিক ও বাস্তব সাহায্য-সহযোগিতা ছিল তুলনাবিহীন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের সহযোগিতা ছিল সর্বজনবিদিত। এই দুটি রাজ্যের নৈতিক, অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি ভারতের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অবদানও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জুগিয়েছে অপরিমেয় প্রেরণা। পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, গীতিকার, গায়ক ও আবৃত্তিশিল্পীদের অবদানকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আমার বাড়ি ছিল পাবনায়। ১৯৪৭ সালে ভারতে চলে আসি। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল বাংলাদেশে। তাই গান দুটি লিখে সেই জন্মস্থানের ঋণ কিছুটা হলেও আমি শোধ করেছি।’

মুক্তিযুদ্ধের পর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার স্বাধীন বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি শারীরিক অসুস্থতার কারণে। আজীবন তিনি বাংলাদেশের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে গেছেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অবদান বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন ভুলবে না। বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় (মরণোত্তর) ভূষিত করে।