আ.লীগ-জাপার সমঝোতা হয়েও হয়নি

>

• মহাজোট থেকে জাপা পেয়েছে ২৯ আসন।
• এর মধ্যে নিষ্কণ্টক ২৭টি।
• আসন নিয়ে জটিলতা আছে ১৪ দল ও যুক্তফ্রন্টেও।
• আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৫৮ আসনে
• জাতীয় পার্টির প্রার্থী আছে ১৬১ আসনে

আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির সবচেয়ে বড় মিত্র এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়েও হয়নি। জাপা বলছে, মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে তারা ২৯টি আসন পেয়েছে। এর বাইরে ১৩২ আসনে ‘উন্মুক্ত প্রার্থী’ হিসেবে জাপার প্রার্থী আছে।
আবার মহাজোটের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, জাপা যে ১৬১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে, তার মধ্যে ২৯টি মহাজোট হিসেবে পেয়েছে। যার মধ্যে নিষ্কণ্টক আসন ২৭ টি। বাকি দুটিতে জাপার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আওয়ামী লীগের বা ১৪ দলের শরিকদের প্রার্থী আছে। অন্যদিকে জাপার বাকি ১৩২ আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের প্রার্থীরা।

আসন নিয়ে জটিলতা আছে ১৪–দলীয় জোট ও মিত্র যুক্তফ্রন্টেও। এই দুই জোটের শরিকদের ১৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপি ছাড়া বাকিরা আওয়ামী লীগের প্রতীক ‘নৌকা’য় ভোট করবে। কিন্তু গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা যাচ্ছে, এসব শরিকেরা সমঝোতার বাইরে আরও অনেক আসনে নিজ দলের প্রতীকে প্রার্থী রেখেছে।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও তার শরিক বা মিত্রদের সঙ্গে সমঝোতা কতগুলো আসনে কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আওয়ামী লীগ বা জোটের নেতারা।

আওয়ামী লীগ নিজে ২৫৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। ৪২টি আসন ছেড়েছে ১৪-দলীয় জোট, জাপা ও যুক্তফ্রন্টকে। নিজেদের ভাগে বেশি আসন রাখতে পেরে নির্ভার আওয়ামী লীগ। দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, জাপা বা অন্য শরিকদের বাড়তি প্রার্থী ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারবে না।

সমঝোতার বাইরে এভাবে নিজস্ব প্রতীকে বিপুল প্রার্থী দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও জাপা সূত্র থেকে দুই রকম ভাষ্য পাওয়া গেছে। একটি ভাষ্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর-কষাকষিতে শরিকেরা সুবিধা করতে পারেনি। এ জন্যই নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। অপর ভাষ্যটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেই শরিকদের যার যেখানে শক্তি আছে, সে সেখানে নিজেদের প্রার্থী দিতে পারবে বলে জানিয়েছেন। এমন আসনকে সবার জন্য উন্মুক্ত বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যে-ই জয়ী হয়ে আসবেন, তাঁকেই জোটের প্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া হবে। আর শরিকদের প্রার্থীর কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কা দেখা দিলে চাপ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হবে।

কে কত আসন পেল
জাপা গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, মহাজোটের শরিক হিসেবে তারা ২৯ আসন পেয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, তাদের আসলে ২৭টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ওয়ার্কার্স পার্টিকে ৫ টি, জাসদ (ইনু) ৩ টি, জেপি ১ টি, তরীকত ফেডারেশন ২ টি, জাসদ (আম্বিয়া) ১টি আসন পেয়েছে। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পেয়েছে ৩টি আসন। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাপা ও কিছু ধর্মভিত্তিক দল নিয়ে যে ঐক্য, এর নাম দেওয়া হয়েছে মহাজোট। আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দল ও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। আর জাপা করবে দলীয় প্রতীক লাঙ্গলে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, এবার আসন সমঝোতায় দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রথমত, জোটের শরিকদের আসন দেওয়ার ক্ষেত্রে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনে ভোট করেছিল। আসন ছেড়ে দিয়েছিল ৩৬ টি।

এরশাদকে চাপে ফেলে জাপা কবজায়
আওয়ামী লীগ চাপে আছে—এই ভেবে এবার জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ৮০ আসন চেয়ে দর-কষাকষি শুরু করেন। কিন্তু আসন সমঝোতার একপর্যায়ে দলের মধ্যে বিভক্তি এবং এরশাদের নানা দুর্বলতার সুযোগে তাঁকেই উল্টো চাপে ফেলে দেয় আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের চাপে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমানকে দলের মহাসচিব করতে হয়। পরে আবার হাওলাদারকে বিশেষ সহকারীর পদ দিয়ে দলে নিজের পরে স্থান দেন এরশাদ। মনোনয়ন–প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই এরশাদ নিজে সিএমএইচ ও বাসায় আসা-যাওয়ার মধ্যে আছেন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন এরশাদ। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত জাপা আসন সমঝোতায় সুবিধা করতে পারেনি।

আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, মনোনয়ন নিয়ে জাপায় ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর আসন নিয়ে সতর্ক হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এককভাবে এরশাদের চাওয়াকেই মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগ। দলের ভেতরে নানা বিভেদে যুক্ত সব পক্ষেরই প্রার্থী রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারি দলের কৌশলের পাল্টা হিসেবে এরশাদ ১৬১ আসনে দলের প্রার্থী দিয়ে রাখেন। যার মধ্যে ২৯ টিতে মহজোটের প্রার্থী হিসেবে ছাড় পেয়েছে। বাকিগুলোতেও প্রার্থী রেখে দিয়েছেন।

মহাজোটের প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, বর্তমান সংসদে থাকা জাপার ১১ জন সাংসদ বাদ পড়েছেন। নতুন করে নীলফামারী-৩, পিরোজপুর-৩, টাঙ্গাইল-৫ এবং ফেনী-৩ আসন যুক্ত হয়েছে। জাপা বরিশাল-৩ আসনটি নিজেদের দাবি করলেও সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান সাংসদ টিপু সুলতানকে নৌকা প্রতীকে ভোট করার জন্য চূড়ান্ত চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

জাতীয় পার্টি যে ২৯টি আসন পেয়েছে বলছে, তাতে কুড়িগ্রাম-১ আসনও আছে। এখানে জাপার প্রার্থী বর্তমান সাংসদ এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান। আবার নির্বাচন কমিশনে পাঠানো আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত তালিকায় এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছলাম হোসেন সওদাগর। ফলে এখানে মহাজোটের একক প্রার্থী থাকছে না।

পিরোজপুর-৩ আসনের বর্তমান সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী বিএনপিতে ছিলেন। গত নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সাংসদ হন। সম্প্রতি তিনি জাপায় যোগ দিয়ে মহাজোটের মনোনয়ন পেলেন। ফেনী-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। কয়েক দিন পরই তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। তিনি মহাজোটেরও মনোনয়ন পেয়েছেন।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার তাঁদের আরও কম আসন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তিনি দর-কষাকষি করে বাড়িয়েছেন। তাঁর দাবি, জাপা ৩০টি আসন পেয়েছিল। রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় একটা কমে ২৯ হয়েছে।
আরও ১৩২ আসনে প্রার্থী রাখার বিষয়ে মসিউর রহমান বলেন, বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা ছিল। তাঁর দলের প্রার্থীদেরও চাপ ছিল। আওয়ামী লীগও বাধা দেয়নি। এরপরও স্থানীয়ভাবে কেউ সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিলে তাতে জাপা কেন্দ্রীয়ভাবে আপত্তি করবে না।

১৪–দলীয় জোট অনেকটাই নিরুপায়
১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরীকত ফেডারেশন ও জেপি গত নির্বাচনে ১৫টি আসন পেয়েছিল। এবার তারা আরও কিছু আসন বাড়তি চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকের আসন কমেছে। কোনো কোনো শরিককে ছেড়ে দেওয়া আসনে অন্য শরিকদের প্রার্থী থাকায় জটিলতা তৈরি হয়েছে।

ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপির আসন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। বরিশাল-৩ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু সুলতানকে মহাজোটের মনোনয়নে ভোট করার জন্য চূড়ান্ত চিঠি দেওয়ার পর জাপাও সেই আসনটি নিজেদের দাবি করছে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে জেপির বর্তমান সাংসদ রুহুল আমিন ও আওয়ামী লীগের নেতা জাকির হোসেন দুজনকেই মনোনয়নের চিঠি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। জাকির হোসেনের প্রার্থিতা বাছাইয়ে বাতিল হলে জেপিকে বলা হয়, আসনটি তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপিলে জাকির প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ তাঁকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়েছে। ফলে এই আসনটি জেপি হারিয়েছে।

১৪ দলের শরিক ও যুক্তফ্রন্টের যে ১৬ জন প্রার্থী আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় পেয়েছেন, জেপি (প্রতীক–বাইসাইকেল) ছাড়া বাকিরা নৌকা প্রতীকে ভোট করবেন। তবে এর বাইরে ওয়ার্কার্স পার্টি আরও দুটি আসনে নিজেদের প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে। জাসদ (ইনু) সমঝোতা হওয়া তিন আসনের বাইরে আরও ৪টি আসনে মশাল প্রতীকে ভোট করবে। জাতীয় পার্টি (জেপি) বাইসাইকেল মার্কায় ১২ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে। জাসদ (আম্বিয়া) নিবন্ধিত নয় বলে দলটির ৩-৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। গণতন্ত্রী পার্টি কোনো আসন পায়নি। তবে দলটির ৬ জন প্রার্থী নিজস্ব প্রতীকে দাঁড়িয়েছেন।

বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট তিনটি আসনে নৌকা প্রতীক পেয়েছে। এর বাইরে ফ্রন্টের নেতা সমশের মবিন চৌধুরীসহ ২০ জন বিকল্পধারার কুলা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবার সমঝোতায় কোনো আসন পায়নি। দলীয় প্রতীকে ১০ জন প্রার্থী আছেন।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, আসন ভাগাভাগি নিয়ে কিছু অসংগতি আছে। তবে তাঁদের ৫টি আসন নিশ্চিত।

একই আসনে জোটের শরিক ও মিত্র দলের প্রার্থী থাকায় ঝুঁকি থাকছে কি না, জানতে চাইলে মেনন বলেন, এবার জাপা বাদে অন্যরা সবাই নৌকায় ভোট করছেন। ফলে এটা একটা সুবিধার জায়গা।