বাংলাদেশের সঙ্গে তাকাশি হায়াকাওয়ার বিরল বন্ধুত্ব

>

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অজস্র সহমর্মী মানুষ। যুদ্ধের মাঠে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, শরণার্থী শিবিরে, প্রতিবাদে বা জনমত গঠনে কঠিন সেই সময়ে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন। সেই বন্ধুদের কয়েকজনকে নিয়ে এ আয়োজন।

তাকাশি হায়াকাওয়া ছিলেন তাঁর সময়ে জাপানের অন্যতম সফল রাজনীতিবিদ। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে জাপানের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তেমন এক অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল উল্লেখ করার মতো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই ভালোবাসা কেবল গভীরতরই হয়েছে।

১৯৭০ সালের অক্টোবরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ব্যাপক প্রাণহানি হয়। জাপানে থাকা পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন ছাত্র তখন দুর্গতদের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহে টোকিওর রাজপথে নেমে পড়েন। টোকিওর বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুইয়োশি নারার পরামর্শে ছাত্ররা যান সাংসদ হায়াকাওয়ার কাছে। তাঁদের আহ্বানে তাৎক্ষণিক সায় দেন তিনি। সেই থেকে শুরু।

তাকাশি হায়াকাওয়া
তাকাশি হায়াকাওয়া



একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকাশি হায়াকাওয়া ভারতে থাকা শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ অভিযানে যুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জাপানের পক্ষে বাংলাদেশের পাশে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু হায়াকাওয়ার ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁরই পরামর্শে জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিরা মুজিবনগর সরকারের কাছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের একটি প্রতিনিধিদলকে জাপানে পাঠানোর প্রস্তাব পাঠান। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের ঘটনাবলি জাপানিদের সামনে তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার ধর্মরাজিকা বৌদ্ধবিহারের প্রধানসহ বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা জাপান যান। তাঁদের মুখে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরতার কাহিনি শুনে জাপানে অনেকেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

এর ধারাবাহিকতায় হাওয়াকাওয়ার নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় জাপান। এটা ছিল পশ্চিমা বিশ্ববলয়ভুক্ত অগ্রসর দেশগুলো থেকে আমাদের জন্য আসা প্রথম স্বীকৃতিগুলোর একটি।

১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো হাওয়াকাওয়া ছুটে যান বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই একে অন্যের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুতে বিশ্বের বিরাজমান নিষ্ঠুর নীরবতার মধ্যে এই রাজনীতিবিদ এগিয়ে এসেছিলেন ঘটনার নিন্দা জানাতে।

তাকাশি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া দলিলে শেষ ইচ্ছা হিসেবে তিনি বলে যান—মৃত্যুর পর তাঁর দেহভস্মের অর্ধেকটা যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তাঁর দেহভস্ম আজও রাখা আছে ঢাকার কমলাপুরের বৌদ্ধবিহারে। বাংলাদেশের বিজয় আর হাওয়াকাওয়ার মৃত্যুর এই মাসে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।