টাঙ্গাইলে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ ও লাঙ্গল

>

• টাঙ্গাইলের চারটি আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন
• এখানে ধানের শীষের প্রার্থীরা অনেকটাই নিরাপদ।

টাঙ্গাইলে নির্বাচনের চিত্রটি ভিন্ন। এখানে শুধু নৌকা ও ধানের শীষ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে চার প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সাংসদ ছানোয়ার হোসেন, ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন পীরজাদা শফিউল্লাহ আল মুনির, যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠজন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী টাঙ্গাইলের বহুল আলোচিত সিদ্দিকী পরিবারের সদস্য মুরাদ সিদ্দিকী।

শহরে ঢুকতেই চোখে পড়ল নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল ও মাথালের (মুরাদ সিদ্দিকীর প্রতীক) পোস্টার পাশাপাশি সড়কের দুই পাশে দেয়ালে সাঁটানো। শহীদ মিনারের সামনেও দেখলাম চার প্রতীকের ব্যানার ঝুলছে। এখানে কেউ কারও ব্যানার বা পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ সিদ্দিকীর প্রথম নির্বাচনী সভা চলছিল। তাঁর সমর্থকেরা মুরাদ সিদ্দিকীর গুণকীর্তনের পাশাপাশি অপর তিন প্রার্থীকে তুলাধোনা করছিলেন।

এখানে ছানোয়ার হোসেন দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। এর আগে ২০০৮ সালে এ আসনে মহাজোট থেকে সাংসদ হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম। বিলখেলাপির কারণে ২০১২ সালে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। আদালতের নির্দেশে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপির মাহমুদুল হাসান সাংসদ নির্বাচিত হন। কিন্তু বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় মাহমুদুল হাসান প্রার্থী হননি।

স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ সিদ্দিকীকে হারিয়ে ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিক ছানোয়ার হোসেন প্রথমবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী না থাকলেও এবার শফিউল্লাহ আল মুনির প্রার্থী হয়েছেন। তিনি জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক।

আরও অনেক আসনের মতো টাঙ্গাইলেরও চারটি আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দেশের বেশির ভাগ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বিএনপির প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হলেও এখানে সংঘাত হয়েছে নৌকা ও লাঙ্গলের সমর্থকদের মধ্যে। এ ছাড়া মুরাদ সিদ্দিকীর সমর্থকেরাও প্রতিপক্ষকে হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেদিক থেকে ধানের শীষ অনেকটাই নিরাপদে।

গতকাল সন্ধ্যায় স্থানীয় বিএনপির একজন নেতা আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, চার প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও মাহমুদুল হাসান ছাড়া বাকি তিনজনই মহাজোট শিবিরের। নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থী সরাসরি মহাজোটের শরিক এবং মুরাদ সিদ্দিকী নৌকার মনোনয়ন লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ধানের শীষের নির্বাচনী ক্যাম্প কম দেখা যায়। কিন্তু টাঙ্গাইলে ধানের শীষের প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পগুলো সরগরম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যখন আকুরটাকুর আবহাওয়া অফিস মোড়ের নৌকার ক্যাম্প ফাঁকা করে নেতা-কর্মীরা চলে যাচ্ছিলেন, তখনো পাশের ধানের শীষের ক্যাম্পে নানা বয়সের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এর আগে নৌকার ক্যাম্পে যাঁদের সঙ্গে আলাপ হলো, তাঁদের বেশির ভাগ বয়সে তরুণ ও ছাত্র। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন নেতার দাবি, ছানোয়ার হোসেন গত পাঁচ বছরে টাঙ্গাইলের উন্নয়নে যেসব কাজ করেছেন, তাতে তাঁর বিজয় নিশ্চিত। তবে বিএনপির ক্যাম্পের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে ধানের শীষের পক্ষে ‘ভোট বিপ্লব’ হবে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাঙ্গাইল শহরের চেয়ে চর এলাকায় ভোটার বেশি। সে ক্ষেত্রে যে প্রার্থী চর এলাকার ভোট বেশি টানতে পারবেন, তিনিই জয়ী হবেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা মনে করেন, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যেই।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী পীরজাদা শফিউল্লাহ আল মুনিরের নির্বাচনী ক্যাম্প না থাকলেও প্রতিদিনই তাঁর পক্ষে শহরে মিছিল হচ্ছে। এখানে চার প্রার্থীর মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সবচেয়ে ধনবান বলে পরিচিত হলেও হলফনামায় তার প্রমাণ মেলেনি।

টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। একসময় সিদ্দিকী পরিবারের দাপট ছিল নিরঙ্কুশ। তখন খান পরিবার অনেকটা কোণঠাসা ছিল। এখন পরিস্থিতি উল্টে গেছে। সিদ্দিকী পরিবারের কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই। লতিফ সিদ্দিকী ও মুরাদ সিদ্দিকী দুটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী। ঋণখেলাপির কারণে কাদের সিদ্দিকী নির্বাচন করতে পারছেন না। টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি লিয়াকত আলী মনোনয়ন না পেয়ে দল থেকে পদত্যাগ করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগে যোগ দিয়ে ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন। মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে ঢোকার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সফল হননি। তাঁর পেছনে খান পরিবারের ভূমিকা আছে বলেই ধারণা করেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল শহীদ মিনারের জনসভায়ও মুরাদ সিদ্দিকীর সমর্থকেরা দাবি করেছেন, খান পরিবার টাঙ্গাইলের ২৯ জীবন কেড়ে নিয়েছে।

অন্যদিকে খান পরিবার থেকে আতাউর রহমান খান টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। বর্তমান সাংসদ আমানুর রহমান খান মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলায় আসামি হওয়ায় নির্বাচন করতে পারছেন না, তাঁর বাবা আতাউর এই আসনের প্রার্থী।

টাঙ্গাইলে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে যেমন নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া হচ্ছে, তেমনি একই স্লোগান দিয়ে নৌকার বিপক্ষেও ভোট চাওয়া হচ্ছে। গতকাল মুরাদ সিদ্দিকীর জনসভায় প্রায় সব বক্তা জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে বক্তৃতা শুরু ও শেষ করেছেন।

শহরের নিরালার মোড়ে আলাপ হচ্ছিল নাগরিক সমাজের দুই প্রতিনিধির সঙ্গে। জিজ্ঞেস করি, ভোটের হাওয়া কেমন বুঝছেন? জবাবে বললেন, আগেভাগে কিছু বলা যাবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের আগের দিন সবাই ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন হিলারি ক্লিনটন জিতবেন। কিন্তু জিতেছেন ডোনাল ট্রাম্প। এখানেও তেমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আকুরটাকুরপাড়ার বৌ টাওয়ারের সামনে একটি অভিনব ব্যানার টাঙানো দেখলাম। ডিসেম্বরজুড়ে নির্বাচনী ছাড়। এর আগে আমরা ঈদের ছাড়, পূজার ছাড় বা নববর্ষেও ছাড়ের কথা শুনে এসেছি। এই প্রথম নির্বাচনী ছাড়ের বিজ্ঞপ্তি দেখলাম।