হাতিয়ার উন্নয়ন শুধু কথায়

>

• সারা দেশের অর্জন থেকে পিছিয়ে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া
• শিক্ষা, যোগাযোগ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে এই জনপদের মানুষ
• পর্যটন এলাকা বলা হলেও পর্যটন করপোরেশনের নেই কোনো উদ্যোগ

সূর্য ডুবলে হাতিয়া দ্বীপের বেশির ভাগ ঘরে অন্ধকার নেমে আসে। কারণ, ৭ লাখ হাতিয়াবাসীর মধ্যে ৩০ হাজারের ঘরে শুধু বিদ্যুৎ আছে। তা–ও দিনে ছয় ঘণ্টার মতো থাকে। তবে সংসদ নির্বাচন ঘিরে সন্ধ্যার পর সড়কগুলোতে মৃদু আলো বাড়ে। নৌকা ও ধানের শীষের সমর্থকেরা গ্রামের এবড়োখেবড়ো মাটির পথ বেয়ে প্রতিদিন বিকেলে পৌরসভার সামনে জড়ো হন। সন্ধ্যা নামলে তাঁদের হাতে থাকা মুঠোফোনগুলো জ্বলে ওঠে।

দলীয় প্রতীকের পক্ষে উচ্চ কণ্ঠ আর মুঠোফোনের মৃদু আলোর মিছিলগুলো চরকৈলাশ সড়কের দিকে এগোয়। জয় বাংলা আর বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে তারা মুখোমুখি দুটি বিশাল ভবনের চত্বরে ঢুকে পড়ে। একটি ভবনের মালিক বিএনপির প্রার্থী ফজলুল আজিম। আরেকটির মালিক আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাংসদ আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী মোহাম্মদ আলী। সেখানে রাতভর চলে দুই দলের নেতা-কর্মীদের সমাবেশ, স্লোগান আর ভোট জেতার নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা।

আর কয়েক দিন পর ভোট। তাই নোয়াখালী–৬ আসন হাতিয়ায় কারও দম ফেলার সময় নেই। হাতিয়ার মূল সড়ক চরকৈলাশের পাশেই হাতিয়া উপজেলা পরিষদের কার্যালয়। সেখানে দিনভর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যস্ততা চোখে পড়ল। ব্যালট বাক্স আনা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও চলছে। আবার প্রার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের চিঠি গ্রহণও চলছে সমান্তরালে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুর-এ-আলম জানালেন, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সাগর থেকে জেগে ওঠা এই দ্বীপ উপজেলার নির্বাচন পরিচালনার চ্যালেঞ্জগুলো অন্য রকম। হাতিয়া পৌরসভা ছাড়া দ্বীপের কোথাও বিদ্যুৎ নেই। নিঝুম দ্বীপ ও মৌলভীরচরে যাতায়াতের পথ হচ্ছে নদী পারাপার। সড়কগুলোর বেশির ভাগই ভাঙাচোরা। ফলে ভোট শেষে ব্যালট বাক্সগুলো উপজেলা কার্যালয়ে নিয়ে আসাটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা।

উপজেলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৪ সালে হাতিয়ায় বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল। অথচ সেখানে এখনো প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ নেই। ৮০ শতাংশ সড়ক কাঁচা। পাকা সড়কগুলোর অর্ধেকের বেশি ভাঙাচোরা। এসবের কারণ জানতে হাজির হই হাতিয়ার বর্তমান ও সাবেক সাংসদদের কাছে। তাঁদের কাছে জিজ্ঞেস করি, কেন এখনো হাতিয়ার সাক্ষরতার হার জাতীয় গড়ের চেয়ে ৫ শতাংশ পিছিয়ে? জনসংখ্যা দেশের গড় বৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।

অবশ্য বর্তমান সাংসদ ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আয়েশা ফেরদাউস কোনো জবাব দিলেন না। প্রশ্নের উত্তর দিলেন তাঁর স্বামী নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। নির্বাচনে তাঁর স্ত্রী জিতলেই এলাকায় বিদ্যুৎ আসবে। এত দিন হাতিয়ার সন্ত্রাস দূর করতে কাজ করেছেন তিনি। মাদক ও অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করেছেন। এবার হবে উন্নয়ন।

আর বিএনপির প্রার্থী ফজলুল আজিম বলেন, তিনি যখন সাংসদ ছিলেন তখন এখানকার বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করেছেন। বিদ্যুৎ আনার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় একটি প্রকল্প শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সেই প্রকল্প এগোয়নি। আর সড়কগুলো মেরামত না হওয়ায় সেগুলোও এখন ভগ্নদশা।

শিক্ষা, যোগাযোগ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকা হাতিয়ার জন্য অবশ্য আরেক বিপদ উঁকি দিচ্ছে। সেটা হচ্ছে সাগরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বেড়ে যাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক এলাকা ডুবে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন–সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) বিজ্ঞানীরা। এসব এলাকার মধ্যে বাংলাদেশের হাতিয়াসহ দ্বীপগুলো অন্যতম।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ধারাবাহিক ভাঙনে হাতিয়ার আট হাজার হেক্টর ভূমি বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে কৃষি ও পরিণত জমি বেশি করে ভাঙনের মুখে পড়ছে।

হাতিয়া সদর থেকে মৌলভীর চর, জাহাজমারা চর ও সূর্যমুখী চরে যাওয়ার প্রায় ১৪০ কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগই খানাখন্দে ভরা। এই তিন সড়কের দুই ধারেই চোখে পড়ল ঝুপড়িঘরের সারি। রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা এসব বসতি নদীভাঙনে ঘরহারা মানুষের ঠিকানা।

এত সব সমস্যা আর ঝুঁকি মোকাবিলায় হাতিয়া কি প্রস্তুত? জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগগুলো কী কী? এসব প্রশ্ন তুললে হাতিয়ার সংসদ সদস্য প্রার্থীরা এড়িয়ে যান। একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা আর অভিযোগের কথা বলে নির্বাচনের মাঠ গরম রেখেছেন তাঁরা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসের উপনির্বাহী পরিচালক ও পরিবেশ গবেষক মমিনুল হক সরকার প্রথম আলোকে হাতিয়ার মতো দ্বীপগুলোর মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে শোনান আশঙ্কার কথা। তিনি বলেন, হাতিয়ার মতো দ্বীপগুলোকে সামনের দিনগুলোতে ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হুমকি মোকাবিলার জন্য আরও বেশি প্রস্তুত হতে হবে। নয়তো এসব দ্বীপ একসময় বঙ্গোপসাগরের তলে হারিয়ে যাবে।