বগুড়ায় ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা সক্রিয়

>
  • ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা
  • সন্ত্রাসী মূলত বগুড়া শহরকেন্দ্রিক
  • পুলিশের তালিকাভুক্ত দাগি সন্ত্রাসী রয়েছে দুই শতাধিক
  • সন্ত্রাসীর কেউ কারাগারে, কেউ জামিনে

বগুড়া-৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী জি এম সিরাজ। বিএনপির সাবেক এই সাংসদ ২৪ ডিসেম্বর গণসংযোগ করতে যান শেরপুরে। উপজেলার কুসম্বি সড়কের বটতলা এলাকায় তাঁর গাড়িবহরটি হামলার শিকার হয়।

ঘটনার পর এলাকায় গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে ২০-২৫ জন ধানের শীষের প্রার্থীর গাড়িবহরের পথরোধ করে। ঘণ্টাখানেক পর মোটরসাইকেল যোগে আসে ২০-৩০ জন। পুলিশের সামনেই তারা গাড়িবহরে হামলা চালায়। আর জি এম সিরাজ ওই দিন সন্ধ্যায় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং শেরপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপারের কাছে মৌখিক অভিযোগ দেন। তিনি বলেন, হামলাকারীরা ছিল ভাড়াটে ক্যাডার, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।

প্রার্থী ও ভোটারদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, বগুড়ার প্রায় প্রতিটি আসনেই এখন এভাবেই ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা। এসব সন্ত্রাসী মূলত বগুড়া শহরকেন্দ্রিক। ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার করতে নির্বাচনের কিছু প্রার্থী তাদের ভাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী প্রতিপক্ষের প্রার্থীর পক্ষে মহড়া দিচ্ছে এবং শোভাযাত্রা প্রতিহত করতে ককটেল হামলা, মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীদের পাশাপাশি বিএনপি ও তাদের শরিকদের বিরুদ্ধেও ভাড়াটে সন্ত্রাসী খাটানোর অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা ভোটের মাঠে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের আনাগোনার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, জেলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত দাগি সন্ত্রাসী রয়েছে দুই শতাধিক। এসব সন্ত্রাসীর কেউ কারাগারে, কেউ জামিনে আছেন। ভোটের মাঠে এসব সন্ত্রাসীর সক্রিয় হওয়ার তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান চলমান রয়েছে।

ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বগুড়া-২ ও বগুড়া-৫ আসনে। বগুড়া-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, তাঁকে এলাকায় না যেতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী এলাকার বুড়িগঞ্জ, মাঝিহট্ট, কিচক ও আটমুল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অন্তত অর্ধশত ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জনপদে মোটরসাইকেল মহড়া দিচ্ছে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। বগুড়া শহর যুবলীগের একজন সাবেক নেতার নেতৃত্বে দিনদুপুরেই একদিন মহড়া দিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা একজন ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বেও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা মহড়া দিচ্ছে।

বগুড়া-১ আসনের সোনাতলা উপজেলায় ২০ ডিসেম্বর ধানের শীষের প্রচারণার সময় নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এরপর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মান্নান অভিযোগ করেন, ওই দিন ধানের শীষের প্রার্থীর ভাড়া করা ক্যাডাররা বগুড়া শহর থেকে মোটরসাইকেলে করে এলাকায় মহড়া দিতে এসেছিল। এরপর তারা নৌকার সমর্থকদের ওপর হামলা এবং বাড়িঘর ও দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করে।

বগুড়া-৬ (সদর) আসনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী আমিনুল ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোটের মাঠে অবৈধ অস্ত্রধারী ভাড়াটে ক্যাডাররা প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে। কয়েক দিন আগে সাতমাথায় পুলিশের সামনেই তাঁর নির্বাচনী সভায় হামলা চালানো হয়। পুলিশকে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন ইসলাম বলেন, বগুড়ায় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। প্রায়ই এখানে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ক্যাডাররা নির্বাচনে ভাড়াটে হিসেবে কাজ করছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ছাড়া কোনোভাবেই প্রভাবমুক্ত অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়।

নেই বিশেষ অভিযান
বগুড়ার সাতটি নির্বাচনী এলাকার সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁদের অভিযোগ, নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ কোনো অভিযান না থাকায় ভাড়াটে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এবার ভোটের মাঠে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পুলিশের নথিতে বগুড়া জেলায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর সংখ্যা দুই শতাধিক হলেও বাস্তবে তা অনেক বেশি। শুধু বগুড়া শহরেই এ সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগই অবৈধ অস্ত্রধারী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে পুলিশের অভিযানে ২৫২টি অবৈধ অস্ত্র এবং ২ হাজারের বেশি গুলি উদ্ধার হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও মনে করছেন, সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা অস্ত্রের তুলনায় উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের পরিমাণ অনেক কম। গত ১০ বছরে আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের ৪১ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। অর্ধেকের বেশি খুনখারাবিতে ব্যবহার করা হয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি মাসুদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হয়। কিন্তু এবার হচ্ছে না। এটি ভালো লক্ষণ নয়।