গলায় দড়ি দেওয়ার আগ মুহূর্তে যা মনে হলো...

যৌন হয়রানির পর মনে হয়েছিল, আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার চিন্তা এল, আগ মুহূর্তে মনে হলো জীবনে ভালো কোনো অর্জন কি নেই? আছে তো। কোনো প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল পাওয়া বা অন্য কোনো অর্জনের পর তো কত লোক শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তাহলে শুধু একটি মাত্র ঘটনার জন্য আত্মহত্যা করা কি ঠিক? না, ঠিক না। বরং যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ করে অন্যদের সচেতন করতে হবে। হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনে সমর্থন দিতে হবে।

ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের প্রযোজনায় হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে পরিবেশনা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের প্রযোজনায় হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে পরিবেশনা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের প্রযোজনায় হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে একটি পরিবেশনার চিত্র এটি। এতে অভিনয় করেন মূকাভিনয়শিল্পী কামরুন্নাহার মৌসুমী। তিনি এই সংগঠনে দ্বিতীয় মেয়াদে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত এটিই প্রথম পরিবেশনা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত এটিই প্রথম পরিবেশনা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

কামরুন্নাহার মৌসুমী জানালেন, এখনো পর্যন্ত এই আন্দোলন নিয়ে এটিই প্রথম পরিবেশনা। শুধু এই আন্দোলন নয়, সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক অসংগতি এ শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। ধর্ষণের পর জন্ম নেওয়া সন্তানকে মা ডাস্টবিনে ফেলবেন কি না, টক শোগুলোতে কী হয় অথবা পরিবারে টেলিভিশনের রিমোট নিয়ে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই বা ভারতের বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালের প্রভাবসহ বিভিন্ন বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা হয় মূকাভিনয়ের মাধ্যমে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এ সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। টিএসসির নির্দিষ্ট কক্ষে সংগঠনের শিল্পীরা রিহার্সেল করছিলেন। ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে বিশেষ ধরনের সাদা পাউডার, হাতে–পায়ে সাদা মোজা, গায়ে সাদা-কালো ডোরাকাটা পোশাক। সাজসজ্জা বলতে গেলে এই। তবে শিল্পীরা জানালেন, সাদা মানে ভালো, কালো মানে অন্ধকার, এভাবে এই সাজসজ্জার মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয় মূলভাব। কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর মনে হলো, এই শিল্পীরা কত কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু মুখে একটুও শব্দ নেই। তাঁদের পুরো শরীর, চোখ কিন্তু অনেক কথা বলে যাচ্ছে। তাই হয়তো এই সংগঠনের স্লোগান: না–বলা কথাগুলো না বলেই হোক বলা।

শুধু হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নয়, সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক অসংগতি মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরছে সংগঠনটি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
শুধু হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নয়, সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক অসংগতি মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরছে সংগঠনটি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের প্রতিষ্ঠা হয় ২০১১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সংগঠনকে বার্ষিক অনুদান দিচ্ছে। চলতি বছরে এ সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকায় হবে তৃতীয় আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসব হবে। গত বছর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘শুধু বিনোদন নয়, এই শিল্প আমাদের দেশে সত্যিকারের সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। তথ্যকে আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী করবে। সমাজের নানা অসংগতি, অব্যবস্থাপনা, অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, মাদক, ধর্মের বাড়াবাড়ি, ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো বিষয়গুলোকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।’

সংগঠনটির শিল্পীরা শুধু দেশে নয়, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, আর্মেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন।

আলাপের সময় ষাটের দশকের শেষ দিকে কলকাতায় যোগেশ দত্তের কাছে মূকাভিনয়ে হাতেখড়ি পাওয়া পার্থ প্রতিম মজুমদারের কথাও বারবার বললেন সংগঠনের শিল্পীরা। কেননা, দেশের মূকাভিনয়শিল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে প্যারিসপ্রবাসী এই মূকাভিনয়শিল্পীর নাম বলতেই হবে। ২০১৩ সালে প্যারিস থেকে এই শিল্পী প্রথম আলোয় এক লেখায় লেখেন, ‘কথা না বলেও আমরা অনেক কথা বলি, ভাষা ব্যবহার না করেও আমরা দেহ দিয়ে এমন অঙ্গভঙ্গি করি, যা ভাষা উচ্চারণের চেয়েও অনেক বেশি প্রকট ও শক্তিশালী। যাকে নাম দেওয়া হয়েছে “বডি ল্যাংগুয়েজ” বা “দৈহিক ভাষা”। এগুলোকে সম্মিলিত করেই একটা শিল্পের জন্ম হয়েছে, যার নাম “মূকাভিনয়”।’

সাদা মানে ভালো, কালো মানে অন্ধকার—এভাবে সাজসজ্জার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বিষয়বস্তুর মূলভাব। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
সাদা মানে ভালো, কালো মানে অন্ধকার—এভাবে সাজসজ্জার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বিষয়বস্তুর মূলভাব। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের প্রতিষ্ঠাতা মীর লোকমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯-১০ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মূকাভিনয় বিষয়ে একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ মেলে। ২০১১ সালের দিকে একটি সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে সংগঠনের শিল্পীরা রাস্তায় বিভিন্ন পারফর্ম করতেন। দেশে অনেক আগে থেকেই এ শিল্পের যাত্রা শুরু। তবে সেভাবে চর্চার অভাবে মানুষের কাছে তখন বিষয়টি খুব বেশি পরিচিত ছিল না। কেমন-কেমন করে তাকিয়ে থাকতেন। বর্তমানে কেমন করে তাকানোর পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মূকাভিনয় রাখার চেষ্টা করা হয়।

মীর লোকমান বলেন, এটি একটি নির্বাক শিল্পমাধ্যম। সাহসের অভাবে বা সমাজ বাস্তবতায় যে কথাগুলো বলা সম্ভব না, তা–ই বলে দেওয়া হচ্ছে এ শিল্পের মাধ্যমে। সমাজ-রাষ্ট্রের অন্যায়–অত্যাচারের বিপরীতে এ শিল্প কাজ করছে। বলা যায়, নির্বাক ভাষায় শক্তিশালী আওয়াজ তোলা হচ্ছে। এতে দর্শক ও শিল্পীদের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক থাকে। সরাসরি চোখে চোখে কথা হয়। গল্পগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই সমসাময়িক বিষয় থেকে বেছে নেওয়া হয় বলে তা দর্শকদের কাছে পরিচিতই থাকে। গল্প পরিচিত না হলেও খুব সমস্যা হয় না। সহজ ভাষায় গল্প বলা হয় বলে দর্শকেরা তা বুঝতে পারেন।

মূকাভিনয়ের মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে মনে করেন শিল্পীরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মূকাভিনয়ের মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে মনে করেন শিল্পীরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের সভাপতি ফরিদ উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি জানালেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটির মাধ্যমে সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে তাঁর দায়িত্ব।

জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কামরুন্নাহার মৌসুমী জানালেন, পরিবারের সহায়তা ছাড়া এ শিল্পের সঙ্গে বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব না। এ শিল্পে এখনো পর্যন্ত নারীদের সংখ্যা অনেক কম। নেতৃত্বের জায়গায় নারীরা নেই বললেই চলে বলে খানিকটা আক্ষেপও প্রকাশ করেন তিনি।