'আমি ভালো আছি, মা যেন চিন্তা না করে'

>
সাদমান সৌমিক
সাদমান সৌমিক

• সাড়ে আট মাস ধরে নিখোঁজ প্রকৌশলী সাদমান
• নিখোঁজের তিন মাস পর ফোন করেন বাবাকে
• পুলিশের ধারণা, সাদমান জঙ্গিবাদে জড়াতে পারেন
• মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সাদমান বাসায় ফেরেননি

চট্টগ্রাম থেকে সাড়ে আট মাস আগে বাসার কাউকে কিছু না বলে চলে যান এক তরুণ প্রকৌশলী। নাম সাদমান সৌমিক (২৫)। তিনি রেখে যান ব্যবহৃত মুঠোফোন ও ল্যাপটপ। তিন মাস পর ফোন করে বাবাকে জানান, ‘আমি ভালো আছি। মা যেন চিন্তা না করে।’ গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সাদমান বাসায় ফেরেননি। তিনি কোথায় আছেন, তা জানতে পারেনি পুলিশ। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ধারণা, তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, নিখোঁজ সাদমানের বাবার নাম আবদুল আউয়াল। গাজীপুর সদরের বাসিন্দা হলেও রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার পোস্তারপাড় এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন তাঁরা। ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল ফজরের নামাজের পর ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যান সাদমান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছেলেকে না পেয়ে তাঁর বাবা ডবলমুরিং থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেখানে বলা হয়, সাদমান সৌমিক আবদুল আউয়ালের বড় সন্তান। তিনি চট্টগ্রাম রেলওয়ে পাবলিক স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম কলেজে লেখাপড়া করেন। ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পাস করার পর চাকরিতে যোগ দেন। সাদমান সর্বশেষ প্রান্তিক মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলেন।

জিডিতে আরও বলা হয়, ওই বছরের ২২ এপ্রিল রাতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খাবার খেয়ে যথারীতি ঘুমাতে যান সাদমান। পরদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। আবদুল আউয়াল সাদমানের কর্মস্থল প্রান্তিক মেরিন সার্ভিসের অফিসে গিয়ে জানতে পারেন যে আগের দিন অন্য একটি গ্রুপে যোগদানের কথা বলে সেখান থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন তিনি। দিনভর খোঁজ না পেয়ে ওই দিনই ডবলমুরিং থানায় জিডি করা হয়। আর এই জিডির সূত্র ধরেই পুলিশ সাদমানের খোঁজ শুরু করে।

শুরু থেকে ঘটনাটির তদন্ত করেন ডবলমুরিং থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাদমান তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন ও ল্যাপটপ বাসায় রেখে যান। এ কারণে তাঁর অবস্থান নির্ণয় করা যায়নি। কৌশলগতভাবে নিজেকে অধরা রাখতে হয়তো এগুলো রেখে যান। মুঠোফোনে সিম ছিল না। ল্যাপটপে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। এ কারণে তাঁর হদিস পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, চলে যাওয়ার তিন মাস পর ফোন করে সাদমান তাঁর বাবাকে বলেছিলেন তিনি ভালো আছেন। তাঁর মা যেন চিন্তা না করেন। পরে ওই ফোনের অবস্থান পাওয়া গেছে গাজীপুরে। কিন্তু ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ফোনটি নিবন্ধন করায় ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করা যায়নি।

থানা-পুলিশের পাশাপাশি সিটিটিসি ইউনিটও নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়টি তদন্ত করছে। জানতে চাইলে সংস্থাটির চট্টগ্রামের প্রধান মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে সাদমান জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। তাঁকে খোঁজা হচ্ছে।

তবে সাদমানের বাবা আবদুল আউয়াল বলেন, নিয়মিত নামাজ পড়লেও তাঁর ছেলেকে কখনো উগ্রবাদী মনে হয়নি। ধর্মকর্ম নিয়ে কখনো কারও সঙ্গে উগ্র আচরণও করেননি। স্বেচ্ছায় কেন ঘর ছেড়েছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। ছেলের প্রতি তাঁর অনুরোধ, যেখানেই থাকুক জঙ্গিবাদে যাতে না জড়ায়। 

নিখোঁজ কিশোরকে খুঁজতে গিয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি

২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. নাফিস উল ইসলাম নিখোঁজ হয়। সেদিন দুপুরে নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা বলে সে ঘর ছাড়ে। এ ঘটনায় তার বাবা নগরের চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। নাফিসকে খুঁজতে গিয়ে পুলিশ একটা সময় জানতে পারে, সে নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের ১ জানুয়ারি মধ্যরাতে নগরের সদরঘাট এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে দুই জঙ্গি মো. আশফাক ও মো. রাকিবুল হাসান ওরফে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী ওরফে জনিকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাদের কাছে ১০টি গ্রেনেড এবং দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট (আত্মঘাতী বন্ধনী) উদ্ধার করে পুলিশ। তবে ওই বাসায় নাফিস ছিল না। তারাই পুলিশকে জানায়, নাফিস ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসায় আছে। তার সাংগঠনিক নাম আবদুল্লাহ। কিন্তু সে সময় পুলিশ তার খোঁজ পায়নি।

২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি রাজধানীর নাখালপাড়ার ‘রুবি ভিলা’ নামের ছয়তলা ভবনের পঞ্চমতলায় অভিযান চালায় র‍্যাব। এতে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির তিন সদস্য নিহত হন। র‍্যাবের গণমাধ্যমে পাঠানো ছবি দেখে নাফিসের বাবা নজরুল ইসলাম নিশ্চিত করেন একজন তাঁর সন্তান। জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে যদিও তিনি ছেলের লাশ চট্টগ্রামে নেননি।