আ.লীগের জয় ও বিএনপির পরাজয়ের কারণ জানালেন প্রধানমন্ত্রী

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি। ছবি: পিআইডি
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি। ছবি: পিআইডি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ও বিএনপি জোটের বড় পরাজয়ের কারণ জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আওয়ামী লীগের জয়কে প্রত্যাশিত উল্লেখ করে জয়ের পেছনে ১৪টি কারণ তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি জোটের পরাজয়ের সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিপুল বিজয়ের জন্য আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানান। আর সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন শেষ করার জন্য জনগণ, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

ভাষণে শেখ হাসিনা যাঁরা নৌকায় ভোট দিয়েছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ আর যাঁরা ভোট দেননি তাঁদের ধন্যবাদ জানান নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও জোট এবং প্রার্থীকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামাতের সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। তিনি তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।

যে কারণে আওয়ামী লীগের জয়:

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ছিল খুবই প্রত্যাশিত। নির্বাচনের আগে দেশি-বিদেশি জরিপগুলোও এ রকমই ফলাফলের ইঙ্গিত দিয়েছিল। লন্ডন-ভিত্তিক ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট এবং রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের জরিপের ফল মানুষ লক্ষ্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পেছনের কারণ তুলে ধরেন।

  • ১. বিগত ১০ বছরে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে, সাধারণ মানুষ তার সুফল পেয়েছেন।
  • ২. দশ বছর আগে যে বালক/বালিকাটি হারিকেন বা কুপির আলোয় পড়া-লেখা করত, গ্রামে পাকা রাস্তা দেখেনি, তরুণ বয়সে সে এখন বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় পড়াশোনা করছে, মোটরযানে যাতায়াত করছে।
  • ৩. যে বয়স্ক পুরুষ-নারী পরিবারে ছিল অবহেলিত-অপাঙেক্তয়, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা তাঁকে সংসারে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছে।
  • ৪. গ্রাম বাংলার খুব কম পরিবারই আছে, যে পরিবার সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগী নয়। কোনো না কোনোভাবে প্রতিটি পরিবার উপকৃত হচ্ছেন।
  • ৫. কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ভ্যান বা রিকশাচালকসহ নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। ১০ বছর পূর্বে একজন কৃষি শ্রমিক তাঁর দৈনিক মজুরি দিয়ে বড় জোর ৩ কেজি চাল কিনতে পারতেন। এখন তিনি ১০ কেজি চাল কিনতে পারেন।
  • ৬. সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনভাতা বিগত ১০ বছরে আড়াই থেকে তিন গুণ বেড়েছে।
  • ৭. সরকারি ও বেসরকারি খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও সমহারে বেড়েছে। যেমন পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ১৬০০ টাকা থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮ হাজার টাকা হয়েছে।
  • ৮. কৃষিজীবীদের সার, বীজসহ বিভিন্ন উপকরণে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
  • ৯. ব্যবসায় এবং শিল্প-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে একদিকে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে অন্যদিকে রপ্তানি বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছে। যার সুবিধা সাধারণ জনগণ পাচ্ছেন।
  • ১০. পদ্মাসেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহাসড়কগুলোকে চার-লেনে উন্নীতকরণসহ মেগা প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান হওয়ায় সাধারণ মানুষের বর্তমান সরকারের ওপর আস্থা জন্মেছে।
  • ১১. মানুষ নিজের এবং দেশের মর্যাদা চায়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪৬ বছর পর উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা প্রাপ্তি জনগণকেও গর্বিত করেছে। ভিক্ষুকের দেশের দুর্নাম ঘুচেছে। যাঁরা মানুষকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন, তাঁদের মানুষ মর্যাদা দেবেন- এটাই স্বাভাবিক।
  • ১২. আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের পর থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। প্রতিটি সম্ভাব্য প্রার্থী নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ বাড়িয়েছেন এবং এলাকার উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। এবারের নির্বাচনে দলের প্রতিটি নেতা-কর্মী মনোনীত প্রার্থীর জন্য কাজ করেছেন।
  • ১৩. আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক। সরাসরি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা করা হয়েছে। · ১৪. নির্বাচনী প্রচারকালে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাবেক আমলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা- সকলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। একটি সমাজের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন কোনো দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন, তখন তাকে কোনোভাবেই আটকে রাখা যায় না।

যে কারণে বিএনপি জোটের পরাজয়:

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বিএনপির পরাজয়ের পেছনে সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ জোটের নির্বাচনী কৌশল সম্পর্কে জনগণ ভালোভাবেই জানেন। এ নিয়ে কথা বলতে চাই না। তাঁদের পরাজয়ের নানা কারণ রয়েছে:

  • ১. এক আসনে ৩-৪ জন বা তারও বেশি প্রার্থী মনোনয়ন
  • ২. মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ এবং দুর্বল প্রার্থী মনোনয়ন
  • ৩.নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন-সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা
  • ৪. নিজেরা জনগণের জন্য কী করবে, সে কথা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেবে-তাদের প্রচারণায় সেটি প্রাধান্য পেয়েছে।
  •  ৫. সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করা ছাড়া নিজেদের সাফল্যগাথা তারা তুলে ধরতে পারেনি।
  • ৬. ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাতের দেশব্যাপী অগ্নি-সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।
  • ৭. বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতাদের মনোনয়ন তরুণ ভোটাররা মেনে নিতে পারেনি। তরুণেরা আর যাই হোক স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষ নিতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এগুলো ছাড়াও আরও বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে যে সাধারণ ভোটারেরা বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং নৌকার অনুকূলে এবার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি। ছবি: পিআইডি
জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি। ছবি: পিআইডি