অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ১৪২ কর্মচারী নিয়োগ

>
  • প্রভাবশালী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয় ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের নিয়োগ
  • বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত, অস্ত্রধারী এবং আসামিও নিয়োগ পেয়েছেন
  • ১৭ ডিসেম্বর সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন
  • কতজন, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেলেন, তা সিন্ডিকেটকে জানানো হয়নি
  • কিছু জটিলতার কারণে নামগুলো প্রকাশ করা হয়নি: উপাচার্য

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে ১৪২ জনকে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও রয়েছেন। এমনকি নানা অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত, অস্ত্রধারী এবং মামলার আসামিও নিয়োগ পেয়েছেন।

অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এই নিয়োগ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলকে বেছে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ১৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১৯তম সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগটি চূড়ান্ত হলেও ওই সভায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামই উপস্থাপন করা হয়নি।

তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বহিষ্কৃত, অস্ত্রধারী ও মামলার আসামি অন্তত তিনজন নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীদের মধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত ১৭ জন। এ ছাড়া সিন্ডিকেট সদস্য, রেজিস্ট্রার ও মসজিদের খতিব, প্রভাবশালী শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সন্তানসহ আত্মীয়স্বজন নিয়োগ পেয়েছেন ১৪ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এস এম সাদাত আল সাজীব প্রথম আলোকে বলেন, এই নিয়োগপ্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তা সিন্ডিকেট সভায় জানানো হয়নি। কারা কীভাবে নিয়োগ পেলেন, তার কিছুই তাঁরা জানেন না। নির্বাচন কমিটির সুপারিশ সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করার নিয়ম। কিন্তু তা করা হয়নি। সভায় উপাচার্য বলেছিলেন, কিছু ‘সেনসিটিভ ইস্যু’ আছে। তাঁর (উপাচার্য) ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। সে কারণে উপাচার্যের অনুরোধে তা পাস করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কতজন, কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেলেন, তা জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে। বোর্ড যেসব নাম সুপারিশ করেছে, সিন্ডিকেট তা অনুমোদন করেছে।

কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম সিন্ডিকেটে প্রকাশ করা হয়নি কেন জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, কিছু জটিলতার কারণে নামগুলো প্রকাশ করা হয়নি। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেকের ব্যাপারে পুলিশ ‘ভেরিফিকেশন’ হবে। চাকরি দেওয়া মানে এই নয় যে চাকরি স্থায়ী হয়ে গেছে।

নিয়োগ পেয়েছেন বহিষ্কৃত ও অস্ত্রধারী

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ এবং ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ইতিহাস বিভাগের ছাত্র তৌহিদুল ইসলামকে দুই দফায় তিন মাস করে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বহিষ্কৃত এই নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক কাম অফিস সহকারী পদে স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় কোমরে পিস্তল নিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র এস এম আলাউদ্দিন। তাঁকে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উত্তর ক্যাম্পাসের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে কম্পোজিটর পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।

২০১৪ সালের ৫ জুন এক কলেজছাত্রীর অশ্লীল ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগে হাটহাজারী সদর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন মোহাম্মদ রাকিব উদ্দীন। এর আগে ২০১২ সালে মারামারির ঘটনায় ছয় মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। এ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবেও বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। ছাত্রলীগের এই সাবেক নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরে টেলিফোন অপারেটর পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।

আত্মীয়করণ

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব আবু দাউদ মুহাম্মদ মামুনের ছেলে নাজমুস সাআদাত সাকিব ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের গ্রন্থাগার সহকারী পদে নিয়োগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর ছেলে মুশফিক আহমেদ চৌধুরীকে হিসাব নিয়ামক দপ্তরে উচ্চমান সহকারী পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে অধ্যাপক মোজাফফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজের ছেলের জন্য কাউকে কখনো বলিনি। সে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছে। ওই সিন্ডিকেট সভায়ও উপস্থিত ছিলাম না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ চতুর্থ শ্রেণি নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক। তাঁর ছেলে কে এম রায়হান নুর রেজিস্ট্রার দপ্তরে নিম্নমান সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ছেলের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কি বাংলাদেশের নাগরিক না? সে নিয়োগ পেতেই পারে।’ সহকারী প্রক্টর লিটন মিত্র ও হেলাল উদ্দিন আহমদ এবং তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেনের একজন করে আত্মীয়ও নিয়োগ পেয়েছেন।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন সেকান্দর চৌধুরী, সিন্ডিকেট সদস্য সুলতান আহমেদ, শেখ হাসিনা হলের প্রাধ্যক্ষ হেলাল উদ্দিন আহমেদ, বিবিএ অনুষদের এক শিক্ষক, কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতির সভাপতির নিকটাত্মীয় এবং স্থানীয় ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শামীমের এক আত্মীয়কেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে ইউপি চেয়ারম্যান শামীম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে কারও জন্য তদবির করেননি। তবে স্থানীয় চেয়ারম্যান হিসেবে অন্তত ২০০ জনের জন্য সুপারিশ করেছেন। চাকরি হয়েছে কি না, তিনি জানেন না।

তৃতীয় শ্রেণির নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বলেন, কত কিছুই তো হচ্ছে। আর কে বিতর্কিত কে অবিতর্কিত, তা গোয়েন্দা সংস্থা বের করবে। নিয়োগ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়েছে।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ ওসমান গণি, আরমান হেলালী, মোস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী তানজীম হোসেন, সুমন মামুন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক সম্পাদক মনসুর আলী ও সাবেক ছাত্রনেতা আসতারুল হক, কর্মী শহীদুল ইসলাম, ইব্রাহিম খলিল, রেজাউল করিম, মো. রনি, মানিক চন্দ্র এবং হাটহাজারী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, এবার নিয়োগের দৌড়ে ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল মালেক। কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নিয়োগ পাননি তিনি। তবে তাঁর ভাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরেক সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ মামুন ও কর্মী মোহাম্মদ শরীফের ভাইও নিয়োগ পেয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যেকটি নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে নিয়মের ব্যত্যয় কখনো উচিত নয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এ বিষয়টি জানেন না। জানলে ইউজিসির পক্ষ থেকে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।