ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সম্পদ অনুসন্ধানে উদ্যোগ নেই

>
  • মাদকবিরোধী অভিযানে এখন আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চলছে
  • ৬৬ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণের জন্য অবস্থান করছেন
  • কারবারিরা দোষ স্বীকার করে ইয়াবা প্রতিরোধে কাজ করবেন
  • কারবারিদের সম্পদের বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায় না
  • স্থানীয়রা চান ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হোক

আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশি হেফাজতে থাকা ইয়াবা কারবারিরা তাঁদের সহায়-সম্পদ রক্ষা করতে চান। আবার আত্মসমর্পণের পর তাঁদের অবৈধ সম্পদের কী হবে, তাও আলোচনায় আছে। যদিও প্রায় ৯ মাস ধরে মাদকবিরোধী অভিযান চললেও এখন পর্যন্ত তাঁদের সম্পদের অনুসন্ধানে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ইয়াবা উদ্ধার, মামলা ও গ্রেপ্তারের পর এখন আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চলছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে ৬৬ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণের জন্য অবস্থান করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের জেলা ও থানা পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বন্দুকযুদ্ধ এড়াতে ইয়াবা কারবারিরা এলাকাছাড়া অনেক দিন ধরে। এরপর শুরু হয় বাড়িঘরে অভিযান। তখনই তাঁরা একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠান। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, সম্পদ গড়তে ‘ট্যাবলেট ব্যবসা’ করেছেন, সম্পদই যদি না থাকে, তাহলে তাঁদের কী থাকল? এই কর্মকর্তারা জানান, আত্মসমর্পণের ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে পুলিশের চুক্তি হলো, তাঁরা দোষ স্বীকার করে নেবেন এবং ইয়াবা প্রতিরোধে এলাকায় কাজ করবেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁদের ইয়াবা কারবারি হিসেবে যে চিনবে, এটাই তাঁদের অনেক বড় শাস্তি।

বিষয়টি তুলে ধরলে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা উল্টো কিছু প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধ করে যে সম্পদ অর্জন করে, রাষ্ট্র চাইলেই কি তা নিয়ে নিতে পারে? জলদস্যুদের কেউ কেউ বিত্তশালী ছিলেন। আত্মসমর্পণের পর রাষ্ট্র কি তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিয়েছে?

তবে স্থানীয় বাসিন্দারা চান ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হোক।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ইয়াবা কারবারি তাঁদের হেফাজতে নেই। আর ইয়াবা কারবারিদের সম্পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জেলা পুলিশ দিতে পারে না। বিদ্যমান আইনে কী করা যায়, সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) খতিয়ে দেখবে।

অবৈধ সম্পদ খোঁজা হয়নি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ৪ মে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে ইয়াবা কারবারিদের অবৈধ সম্পদ খুঁজে দেখার পরামর্শ উত্থাপিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উদ্যোগ নিতে পারে, এমন আলোচনা ছিল। কিন্তু তথ্যানুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ মাঠপর্যায়ে শুরু হয়নি।

জেলা আয়কর অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন টেকনাফে একটি জরিপ হবে। ওই জরিপে কর দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা কত এবং কারা অবৈধ সম্পদের মালিক, তা বেরিয়ে আসবে। তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো চিঠি হাতে পাননি।

আইনজীবি শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ৩৫ ধারায় মাদক ব্যবসালব্ধ অর্থ বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিচারিক প্রক্রিয়া উল্লেখ আছে। ওই সম্পত্তি বা অর্থ মাদক ব্যবসা থেকে লব্ধ, সেটা বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হওয়ার পর আদালতের আদেশে বাজেয়াপ্ত করা যাবে।

ইয়াবা কারবারিরা কত ধনসম্পদের মালিক?

এ বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আয়কর কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে মাদক কারবারির তালিকায় ২ নম্বরে থাকা সাইফুল করিম ৮৬ লাখ টাকা কর দিয়ে কক্সবাজার জেলার শীর্ষ করদাতার পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেরা করদাতার তালিকায় ছিলেন সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি ও তাঁর ভাই আবদুস শুক্কুরও। ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, টেকনাফে মূলত যাঁরা বন্দরে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত, তাঁরা নিয়মিত কর দেন। তাঁদের অনেকে বৈধ ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ব্যবসা করেন। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, শীর্ষ ৭৩ ইয়াবা কারবারির ১৬ জনের আমদানি-রপ্তানির বৈধ ব্যবসা আছে। তাঁদের সম্পদের কতটা বৈধ, কতটা অবৈধ, সেটা প্রমাণ করা দুরূহ হবে।

টেকনাফে ৭৩ শীর্ষ ইয়াবা কারবারি বা ১ হাজার ১৫১ মাদক কারবারির কার কী সম্পদ, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও অভিযানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাছ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

২১ জানুয়ারি টেকনাফের হ্নীলার পশ্চিম শিকদারপাড়ার মো. শামশুল ওরফে বর্মাইয়া শামশুর গুলশানে ছয় ইউনিটের একটি ১০ তলা ভবন, হ্নীলায় একটি ভবন, তিনটি ট্রাক ও তিনটি বাস রয়েছে। তাঁর সম্পদের বড় অংশই তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে বলে জানা গেছে।

নাজিরপাড়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুলিশ তিন দফায় বুলডোজার দিয়ে তাঁর বাড়িটি একরকম গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ওই বাড়ি প্রায় এক বিঘা জায়গার ওপর। তাঁর দুটি নোয়া গাড়ি, মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা আছে। তাঁর ভাই আবদুর রহমান আত্মসমর্পণ করতে গেছেন। তাঁর দোতলা বাড়ি, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ৩০০ কানি লবণমাঠের জমি আছে।

জালিয়াপাড়া থেকে আত্মসমর্পণ করতে পুলিশি হেফাজতে আছেন এক ব্যক্তি। তাঁর দোতলা ভবনটিতে দুই দফা অভিযান চালায় পুলিশ। ভবনটি তৈরিতে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান ওই ব্যক্তির বাবা। দিন দুয়েক আগে ভবনটি ঘুরে দেখানোর সময় তিনি বলেন, বাড়িতে ১২টি ঝাড়বাতি ছিল। সব বিদেশি এবং একেকটির দাম ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আসবাব শুধু সেগুনকাঠের নয়, দরজাও। বাড়িতে এলইডি টিভি চারটি। সবই পুলিশ ভেঙে দিয়েছে। তাঁর ছেলে আনন্দ-ফুর্তি করতে ভালোবাসেন। মাঝেমধ্যে গোটা এলাকার ছেলেদের দাওয়াত করেন। এত সম্পদের উৎস কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি শুঁটকির ব্যবসা করেন আর তাঁর ছেলে ‘একটু-আধটু’ ট্যাবলেটের ব্যবসা করেছেন।

একসময়ের জেলে ও রিকশাচালক নুরুল হক ভুট্টো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. একরাম, পিঠা বিক্রেতা লেইট্টা আমির কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে। চলতি অর্থবছরে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আয়কর বিভাগের পরিদর্শক দল ২৫-৩০টি বড় ভবনে যান, কিন্তু ভবনমালিককে পাননি। তাঁরা পালিয়ে আছেন বলে জেনেছেন। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজন মারফত জানিয়েছেন, ঝামেলা মিটে গেলে কর দেবেন।

ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ। আবার পুলিশের সিআইডি আর্থিক অপরাধের তদন্তও করে থাকে।

জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) বিশেষ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা ৫০ জনের মতো ইয়াবা কারবারিকে নোটিশ দিয়েছেন। কোনো অসংগতি পাওয়া গেলে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে। জনবলসংকটের কারণে কাজটা দ্রুত করে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।