ভুয়া 'মেজর' জাফরের ভয়ংকর প্রতারণা

>• চাকরির প্রলোভন দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়েছেন জাফর
• র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর জাফর এখন কারাগারে
• একই কাজে জড়িয়ে পড়ায় জাফরের স্ত্রীও গ্রেপ্তার
চাকরি করেছেন সৈনিক হিসেবে, তাও ৪৭ বছর আগে। কিন্তু চলনে-বলনে পুরোপুরি কর্মকর্তা। নিজেকে পরিচয় দেন ‘মেজর’ বলে। এই পরিচয়ের বিস্তারও ঘটান। শুরু করেন এক ভয়ংকর প্রতারণা। চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা।
এই ব্যক্তির নাম সৈয়দ আবু জাফর। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর তিনি এখন কারাগারে। একই কাজে জড়িয়ে পড়ায় জাফরের স্ত্রী শিল্পী আক্তারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র্যাব-২-এর মোহাম্মদপুর ক্যাম্প ১৯ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে। পাবনা ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত এক গাড়িচালক ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ৭৯ লাখ টাকা এবং আরও ছয় চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে অন্তত ৭২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে এই দম্পতির বিরুদ্ধে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, সৈয়দ আবু জাফরের নেতৃত্ব এই প্রতারক চক্রে তাঁর স্ত্রী বাদে আরও ছয়জন আছেন। আতাউর রহমান খান নামের আরেক ব্যক্তি আবু জাফরের ডান হাত হিসেবে কাজ করেন। চাকরিপ্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলাই তাঁদের কাজ। প্রাথমিকভাবে আবু জাফরের দেড় কোটি টাকা প্রতারণার তথ্য পেলেও এই সংখ্যাটি আরও বড় বলে তাঁরা মনে করছেন। মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লায় তাঁর সাড়ে চার কাঠা, দারুস সালাম এলাকায় ছয় কাঠা জমি আছে।
সৈয়দ আবু জাফরের এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন পাবনা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর স্বজন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আবু জাফরের ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইউনুস ছিলেন তাঁর দূরসম্পর্কের আত্মীয়। নিজের ছোট ভাইয়ের জন্য চাকরি খুঁজতে গিয়ে আবু জাফরের সঙ্গে ইউনুসই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম দিন ঢাকায় আসার পর তিনি তাঁদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ঘুরিয়ে দেখান। চাকরির বিষয়ে এক বড় কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে তাঁদের গাড়িতে রেখে একটি বাসায় গিয়ে ঘণ্টা দু-এক কথা বলে আসার নাটকও করেন। এসব দেখে তাঁরা বিশ্বাস করেন। কয়েক দিন পর তিনি নৌবাহিনীতে চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র দেন। বিনিময়ে ছয়জনের কাছ থেকে ৭৯ লাখ টাকা নেন। কিন্তু এরপর আর নিয়োগের বিষয়ে তিনি কোনো যোগাযোগ করেননি।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তাঁরা ২০১৬ সালে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেন। আবু জাফর তখন তাঁদের ৭৫ লাখ টাকার দুটি চেক দেন। কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে তাঁরা দেখেন ওই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। আবারও প্রতারিত হয়ে তাঁরা পাবনা আদালতে চেক জালিয়াতির মামলা করেন। কিন্তু গত দেড় বছরেও কোনো কূল-কিনারা না হলে তাঁরা র্যাবের কাছে যান।
আবু জাফর ও তাঁর স্ত্রীর একটি কৌশলী প্রতারণার বর্ণনা মেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুবক আল আমিনের কাছে। চাকরির জন্য তিনি ও তাঁর এলাকার আরও ছয় যুবক সাইদুর রহমান নামের এক কৃষকের মাধ্যমে আবু জাফরের সহযোগী আতাউর রহমান খানকে ৭২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু নিয়োগের জন্য যশোর নিয়ে যাওয়ার কথা বলে জাফর দম্পতি কৌশলে তাঁদের শিক্ষাজীবনের সব সনদ ছিনিয়ে নেন।
আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বাবার এক বিঘা কৃষিজমি ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করে এবং বোনের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা ধার করে তিনি দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি যশোর নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আবু জাফর ও আতিউর রহমান তাঁদের একটি মাইক্রোবাসে করে সাভারের দিকে রওনা হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পার হওয়ার পর নাশতা খাওয়ার কথা বলে পর্যটন হোটেলে তাঁদের নিয়ে ঢোকেন। ২০-২৫ মিনিট পর ফিরে এসে দেখেন তাঁদের ব্যাগ ব্যাগেজ কিছুই নেই। আবু জাফর জানান কেউ দরজার তালা ভেঙে সব নিয়ে গেছে।
আবু জাফর ওই মাইক্রোবাসটি ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর চালক ছিলেন আজহার মুনশি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আবু জাফরের স্ত্রী শিল্পী বেগম আরেকটি মাইক্রোবাস নিয়ে তাঁদের মাইক্রোবাসের পিছু পিছু গিয়েছিলেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চাকরিপ্রত্যাশী যুবকদের নিয়ে আবু জাফর হোটেলে ঢোকার পরপরই তাঁর স্ত্রী মালামাল সব নিজের মাইক্রোবাসে সরিয়ে নিয়ে সটকে পড়েন।
র্যাব-২-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, সৈয়দ আবু জাফর মেজর পরিচয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন। স্ত্রী বাদেও তাঁর চক্রে আরও কয়েকজন রয়েছেন।
আরও পড়ুন:
প্রতারণার অভিযোগে তিন জন আটক