টিনের বদলে ইটের ঘর পেয়েও কপালে ভাঁজ

আধা পাকা ঘর তৈরি শেষ। দেয়ালের প্লাস্টার বাকি। সেটা নিয়েই চিন্তায় সুবিধাভোগীরা।  প্রথম আলো
আধা পাকা ঘর তৈরি শেষ। দেয়ালের প্লাস্টার বাকি। সেটা নিয়েই চিন্তায় সুবিধাভোগীরা। প্রথম আলো

টিনের জায়গায় পেয়েছেন আধা পাকা ঘর। জানালা–দরজা এখনো লাগেনি। তাতে কী? আনোয়ারা বেগমের স্বপ্ন এখনই দৃশ্যমান। মিস্ত্রিরা বলেছেন, কদিন বাদেই লাগবে জানালা-দরজা। তারপরই তিনি উঠতে পারবেন নিজের ঘরে। তবে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের নবগ্রামের ষাটোর্ধ্ব এই নারীর কপালে নতুন করে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। মিস্ত্রিরা জানিয়েছেন, ঘরের দেয়াল তাঁরা প্লাস্টার করে দেবেন না। আনোয়ারার চিন্তার কারণ এটিই। কারণ, তাঁর প্লাস্টার করার সামর্থ্য নেই। আদৌ কখনো হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় শ্রীপুর উপজেলায় আনোয়ারা বেগমের মতো যাঁদের জমি আছে, ঘর নেই—এমন ৭৪৪ জন ঘর পাবেন। পুরো জেলায় এই সংখ্যা ১ হাজার ৩৮৮। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, তাঁদের সবার টিনের ঘর পাওয়ার কথা, যেখানে প্রতি ঘরের জন্য বরাদ্দ এক লাখ টাকা। তবে ব্যতিক্রম শ্রীপুরের ৫৩৬ জন সুবিধাভোগী। প্রথম পর্যায়ের ২০৮ জন বাদে বাকি সবাই পাবেন টিনের চালের আধা পাকা ঘর। অনেকের ঘর ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। কিছু কাজ চলমান। উপজেলা পিআইও অফিস বলছে, চ্যালেঞ্জিং হলেও নির্বাহী কর্মকর্তার সদিচ্ছা ও তাদের সবার প্রচেষ্টায় এটি সম্ভব হচ্ছে।

ঘর পেতে কাউকে টাকা দিতে হয়নি। তবে ঘরের জন্য এক গাড়ি বালি কিনে দিতে হয়েছে মাশালিয়া গ্রামের নার্গিস বেগমকে। উপজেলা থেকে যে টিন ও সিমেন্ট এসেছে, তার ভ্যানভাড়াও দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে যে খরচ হয়েছে, তার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁকে। প্রায় একই রকম অভিযোগ গয়েশপুর ইউনিয়নের কুশা ইছাপুর গ্রামের আরও কয়েক জনের। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, এসব কোনো খরচই উপকারভোগীদের হওয়ার কথা নয়। কারণ, এসব খরচ তাঁর হিসাবের মধ্যেই আছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

একজন উপকারভোগী জানালেন, ইট, সিমেন্ট ও টিন ভালো মানের দেওয়া হলেও পুতা অর্থাৎ ভিত্তি ছাড়াই তৈরি হচ্ছে সব ঘর। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে এর স্থায়িত্ব নিয়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ইটের দেয়ালের এসব ঘরে থাকছে না কোনো ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি। মাটির নিচে একটি ইট চওড়া করে দিয়ে তার ওপর থেকে ফ্লোর পর্যন্ত ছয়টি ইট দিয়ে হচ্ছে পাঁচ ইঞ্চির গাঁথুনি। ওপরে জানালার অংশ ছাড়া দেওয়া হচ্ছে না লিংটেল।

বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট অনেকেই। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির একজন সদস্য গয়েশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম মোল্লা। ঘরের স্থায়িত্ব নিয়ে তিনি বলেন, ফাউন্ডেশন ও লিংটেল বাদে এই ঘর বড় ঝড়–বাতাস এলে ধসে পড়তে পারে। এ বিষয়ে তাঁদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি তাঁর।

স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ প্রকৌশলীদেরও। উপজেলা প্রকৌশলী দিলীপ কুমার কর্মকার বলেন, ইটের ঘরের একটা ফাউন্ডেশন দরকার। আর পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের ক্ষেত্রে মূল যে জিনিসটা দেওয়া উচিত, তা হলো সাড়ে ছয় ফিট বা সাত ফিট উচ্চতায় চতুর্দিকে একটা লিংটেল ব্যবহার করা। এই লিংটেল না থাকলে দেয়াল অনেক সময় ধরে রাখতে সক্ষম হয় না। মাটি কোনো কারণে সরে গেলে বা ঝড়ঝাপটা এলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

প্রকৌশলী দিলীপ কুমার কর্মকার মনে করেন, কেন্দ্র থেকে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ীই কাজ করা উচিত। কারণ, অনেক চিন্তা করে এই নকশা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এই প্রকল্পেও মূল কাঠামো পরিবর্তন না করে প্রেরিত প্ল্যান, ডিজাইন ও প্রাক্কলন মোতাবেক গুণগত মান বজায় রেখে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে এর দায় উপজেলা প্রকৌশলীর ওপরও বর্তায়। তবে এই পরিবর্তিত নকশার বিষয়ে তাঁর কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বলে দাবি দিলীপ কুমারের।

এ বিষয়ে ইউএনও দিলারা রহমান বলেন, এক লাখ টাকায় ইটের ঘর দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। এটা জেনেও সুবিধাভোগীদের আরও ভালো কিছু উপহার দেওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জটা তিনি নিয়েছেন। আর বাড়িগুলোর স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন নেই বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, যেহেতু ওপরে ছাদ দেওয়া হচ্ছে না, তাই ফাউন্ডেশন বা লিংটেল পুরো না হলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এই অঞ্চল বড় কোনো দুর্যোগপ্রবণ এলাকাও নয়। তাই সমস্যা হবে না। প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই পরিবর্তিত নকশায় কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শ্রীপুর ইউএনও অফিস বলছে, ঝিনাইদহের শৈলকূপা ও খুলনার রূপসা উপজেলায়ও পাইলট প্রকল্প হিসেবে কিছু ঘর এভাবে তৈরি হয়েছে। বিষয়টি খুলনা বিভাগীয় কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন।

বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২–এর প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। সরেজমিনে দেখে এর স্থায়িত্ব বিচার করা যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন বলেছেন, এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে আধা পাকা ঘরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তিনি বলেন, টিনের ঘরের চেয়ে ইটের ঘরের চাহিদা বেশি। এটা মানুষ ভালো মনে করে। তবে সেটা স্থায়ী হলো কি না, তা–ও খতিয়ে দেখতে হবে। ঘরগুলোর স্থায়িত্ব প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।