মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তাব আনছে ইইউ

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।
>
  • মানবাধিকার কাউন্সিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নতুন প্রস্তাব আনছে ইইউ
  • মার্চে বাংলাদেশে আসছে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতিনিধিদল
  • ৪০তম অধিবেশনেই প্রস্তাব তোলা হবে

রোহিঙ্গা নিধনের অপরাধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে নতুন করে প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। জেনেভায় আগামীকাল সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৪০তম অধিবেশনেই এই প্রস্তাব তোলা হবে।

ঢাকা ও জেনেভার কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে জানায়, ইইউর নতুন প্রস্তাবটি অধিবেশন শুরুর প্রথম সপ্তাহেই উঠতে পারে। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রস্তাবে ১৯ দফার সুপারিশ থাকবে। এর মধ্যে অন্তত ৪টি সুপারিশ শুধুই রোহিঙ্গাদের নিয়ে। এসব সুপারিশে সুনির্দিষ্টভাবে মিয়ানমারের সেনাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যথাযথ তদন্ত করে শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাদের নৃশংসতা নিয়ে জেনেভায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উচ্চকণ্ঠ হওয়ার এই সময়টাতেই বাংলাদেশ সফরে আসছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) একটি প্রতিনিধিদল। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগ থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলাল গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, মূলত গণহত্যার প্রাথমিক অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহের জন্য আইসিসির প্রতিনিধিদলটি মার্চের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির সফরে যাবে।

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান নিয়ে আবারও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে মিয়ানমার। গত শুক্রবার জেনেভায় সিডও (নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সিডও সনদ গ্রহণ করে) কমিটির বিশেষজ্ঞরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কোন ইউনিট আর কোন অধিনায়কের নেতৃত্বে রাখাইনে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা জানতে চান। সিডওর ওই বৈঠকে অতীতের মতোই মিথ্যাচার করেছে মিয়ানমার। অধিবেশনের শেষ দিকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে সিডওর বিশেষজ্ঞদের অন্যতম এন হায়দার এল আদাল বলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও আছে। চাইলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লিখিতভাবে জানানোর সুযোগ আছে। মানবাধিকার পরিষদের ৪০তম অধিবেশনে সুপারিশ দেওয়ার কথা রয়েছে সিডওর।

জেনেভায় কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৪০তম অধিবেশনের শুরুতে বক্তব্য দেবেন মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশলেতে। তাঁর বক্তব্যে অন্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এ ছাড়া মিয়ানমার নিয়ে ১১ মার্চ বক্তৃতা দেওয়ার কথা মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ের ইয়াংহি লির। তিনি গত মাসে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।

রাখাইনে নিরাপত্তাচৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভয়াবহ নৃশংসতা শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নির্বিচারে খুন, গণধর্ষণ ও হেলিকপ্টার থেকে দাহ্য পদার্থ দিয়ে রাখাইনের জনপদ নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে নামে মিয়ানমার। এর তিন মাসের মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গণহত্যা’ আর ‘জাতিগত নিধন’ চালানো হয় বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ। সারা বিশ্বের সমালোচনার মুখে পড়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তি সই করে মিয়ানমার। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও রাখাইনে এমন কোনো পরিবেশ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তৈরি করেনি, যা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরতে উৎসাহ দেয়। উল্টো মিয়ানমার বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

ইইউর নতুন প্রস্তাব

ঢাকা ও জেনেভার কূটনৈতিক সূত্রে যোগাযোগ করে জানা গেছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তৈরি করা ইইউর খসড়া প্রস্তাবটি ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এবং বেশ কয়েকটি দেশের সমর্থন নিয়ে যৌথভাবে মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে উত্থাপনের চেষ্টা চলছে।

মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এর আগে দেওয়া জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে ইইউ। একই সঙ্গে মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের স্বার্থে দ্রুত আন্তর্জাতিক স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া (আইআইআইএম) কার্যকরের সুপারিশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সেনাসদস্যের বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে সব ধরনের অভিযোগের স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের সুপারিশও করা হয়েছে।

ইইউর খসড়া প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানের সুপারিশ অনুযায়ী বিচারের কথা এতে (প্রস্তাবে) উল্লেখ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সংকটের মূল উৎস মিয়ানমারের রাখাইনে। তাই বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে সংকটের সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে, স্বেচ্ছায় আর মর্যাদার সঙ্গে সেখানে ফিরে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে পারে, সে জন্য রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করতে বলেছে ইইউ। এ জন্য ২৮-দেশের ইউরোপীয় জোটটি মিয়ানমারকে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সমঝোতা স্মারক মেনে চলার সুপারিশ করেছে।

ইইউ বলছে, রাখাইনসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের স্বার্থে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সব ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান করতে হবে। মিয়ানমারের সংঘাতকবলিত এলাকাগুলোতে এখনো আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, কূটনীতিক ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের যেতে দেওয়া হয় না। এ বিষয় উল্লেখ করে ওই সব এলাকায় দ্রুত অবারিতভাবে লোকজনের চলাফেরা নিশ্চিত করতে বলেছে ইইউ।