প্রতি মাসে একটি প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লাগে

>
  • লালবাগ–চকবাজার এলাকায় প্রচুর প্লাস্টিকের কারখানা
  • প্লাস্টিকের কারখানায় প্রায়ই নানাভাবে আগুন লাগে
  • আবাসিক ভবনের নিচে কারখানা বা গুদাম ভাড়া
  • প্লাস্টিকের কারখানা সাংঘাতিক ঝুঁকি তৈরি করছে

রাজধানীর লালবাগ ফায়ার স্টেশন গত এক বছরে যতগুলো আগুন নিভিয়েছে, তার ৭৪ শতাংশই ছিল প্লাস্টিকের কারখানা, গুদাম ও দোকানের। এর মধ্যে প্লাস্টিকের কারখানা প্রায় ৪৮ শতাংশ। গড়ে প্রতি মাসেই একটি প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লাগে।

লালবাগ ফায়ার স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁরা আগুন নেভানোর ৮০টি ডাক (কল) পেয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ২৩টি অগ্নিকাণ্ড ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে নেভান। বাকিগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই সেগুলো নিভে গেছে বা স্থানীয় লোকজন নিভিয়ে ফেলেছেন বলে খবর আসে।

যে ২৩টি স্থানের আগুন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নেভাতে গিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে ১১টি ছিল বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের কারখানা। চারটি ছিল বিভিন্ন ধরনের স্কুলব্যাগ, পাটের বস্তা, ক্রোকারিজ ও কার্টনের গুদাম। দুটি ডেকোরেটরের দোকানেও আগুন লেগেছিল। আর বাকি ছয়টি আগুনের ঘটনা ছিল আবাসিক ভবনে।

লালবাগ ফায়ার স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা রতন কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কর্মক্ষেত্র লালবাগ ও চকবাজার থানা এলাকা মিলিয়ে। এসব এলাকায় প্রচুর প্লাস্টিকের কারখানা। এসব কারখানায় প্রায়ই নানাভাবে আগুন লাগে। আর এখানকার ৭০ শতাংশের বেশি আবাসিক ভবনের নিচে কারখানা অথবা গুদাম ভাড়া দেওয়া হয়েছে, যা ঝুঁকি তৈরি করছে।

ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে, প্রতি মাসেই গড়ে একটি করে প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লাগে। কিন্তু এসব কারখানার অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস তেমন কার্যকর কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। ওই এলাকায় মাঝেমধ্যে অগ্নিসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হলেও তার পরিসর খুবই সামান্য। সেগুলো সাধারণ ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলছে না। লাভ দেখেই সন্তুষ্ট ব্যবসায়ীরা, ঝুঁকিকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছেন না।

গতকাল শনিবার লালবাগের ইসলামবাগে কথা হয় একটি প্লাস্টিক কারখানার মালিকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, একটি প্লাস্টিক কারখানার জন্য ফায়ার লাইসেন্স পেতে যে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, তা বলার মতো নয়। পরে যখন তিনি নতুন একটি কারখানা খুলেছেন, সেটির জন্য আর ফায়ার লাইসেন্সের চিন্তাও করেননি। এখানে বেশির ভাগ কারখানারই ফায়ার লাইসেন্স নেই। কিন্তু এখানে যে বেচাবিক্রি, তা অন্য কোথাও নেই। যার কারণে ব্যবসায়ীরা অন্য কোথাও যেতে চান না।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ওই এলাকায় কারখানাগুলোকে কয়েক বছর ধরেই কোনো ফায়ার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। তবে ব্যবসায়ীরা ফায়ার লাইসেন্স বা কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদনের ধার ধারেন না। জায়গা একটা পেলেই তাঁরা কারখানা গড়ে তোলেন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, গত বছরের আগস্টে কোরবানির ঈদের পরের দিন লালবাগের আলীঘাটে একটি প্লাস্টিকের দানা তৈরির কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ভাষায় ওটা ছিল ‘বড় আগুন’। আগুন থেকে অন্য ভবনগুলো রক্ষা করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ওই কারখানায় প্রচুর কুচি প্লাস্টিক, ধোয়া প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকের দানা রাখা ছিল। আগুনে এসব পুড়ে যায়। তাতে বিকট কালো ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় আশপাশের এলাকা ছেয়ে যায়। পড়ে তদন্তে দেখা যায়, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বৈদ্যুতিক মিটারের ঠিক নিচেই রাখা ছিল প্লাস্টিকের দানার বস্তা। কোনোভাবে মিটারে আগুন ধরে সেটি দানার বস্তায় গিয়ে লাগে। এরপর আগুন পুরো কারখানা ও গুদামে ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশে আট-দশটি ঘরও ওই আগুনে পুড়ে যায়। লালবাগসহ অন্য ফায়ার স্টেশনের ১৩টি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভায়।

আলীঘাটে ওই কারখানায় আগুন লাগার চার মাস পরই একইভাবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে আরেকটি প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লাগে। ওই আগুনে আরও ১৬টি ছোট কারখানা এবং ২০টির মতো গুদাম পুড়ে ছাই হয়।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, লালবাগে কোনো ভবনের নিচতলায় বা টিন-কাঠের বাড়িতে কারখানাগুলো বসানো হয়। খুব অল্প জায়গায় যন্ত্রপাতি ও পণ্য গায়ে গা লাগিয়ে রাখা হয়। বৈদ্যুতিক সংযোগ ও মিটারের নিচের জায়গাটুকুও তাঁরা খালি রাখেন না। ফলে আগুন লাগে প্রায়ই।

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মারা যাওয়ার পর সরকারি মহলে বেশ তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। সেখান থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর গত বুধবার রাতে চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। আবারও এসব গুদাম ও কারখানা সরানোর কথা বলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে নগর–পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকায় এসব কারখানা ও গুদামে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দ্রুত এগুলোর জন্য অন্যত্র পরিকল্পনামাফিক নির্দিষ্ট অঞ্চল গড়ে তোলা জরুরি। সেই অঞ্চলে কোনো আবাসিক ভবন থাকবে না এবং অগ্নিনির্বাপণের সুব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এরপরই পুরান ঢাকা থেকে এসব কারখানা ও গুদাম সেখানে সরাতে হবে। তড়িঘড়ি করলে এসব কারখানা ও গুদাম যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে পড়বে। এতে ঝুঁকি আরও বাড়বে।