করতোয়া থেকে সাত দিনের মধ্যে স্থাপনা সরাতে নোটিশ

দখল আর দূষণে বিপন্ন করতোয়া নদী। সম্প্রতি বগুড়া শহরের চেলোপাড়া শীতলাস্নান ঘাট এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
দখল আর দূষণে বিপন্ন করতোয়া নদী। সম্প্রতি বগুড়া শহরের চেলোপাড়া শীতলাস্নান ঘাট এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ায় করতোয়া নদীর অবৈধ স্থাপনা আগামী সাত দিনের মধ্যে সরিয়ে নিতে দখলদারদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পৌরসভাসহ ৩০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এ নোটিশ পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের ভূমি শাখা থেকে গত সোমবার পাঠানো এই নোটিশে সাত দিনের মধ্যে নদীর সীমানা থেকে অবৈধ স্থাপনা নিজ নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিতে বলা হয়। বেঁধে দেওয়া সময়ের পর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সেসব স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
পৌরসভা, বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ, শহরের মালতিনগর এলাকার মোহাম্মদ বাদশা, হাজেরা বেগম, বাহালুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, লাল মিয়া, বুলু মিয়া, জাকির হোসেন, খলিলুর রহমান, মাটিডালি এলাকার আরিফ হোসেন, নাটাইপাড়ার সাইদুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন, মশিউর রহমান, লুৎফর রহমান, আরিফা বেগম, আবুল কাশেম, বজলুর রশিদ, বজলার রহমান, মো. মিল্টন, গৌর দাস, অনিল কর্মকার, গোপাল চন্দ্র দাস, রাধা চন্দ্র দাস, প্রহল্লাদ, বগুড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল, গোপীনাথ মন্দির এবং সাহেব বাজার বায়তুল হামদ জামে মসজিদকে এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। টিএমএসএস এবং পৌরসভা একাধিক স্থানে নদী দখল করায় আলাদাভাবে দুটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া শহর ও শহরতলির বিভিন্ন অংশে করতোয়া নদী দখলকারী ৩৮ জনের তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছিল। এই তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি তোলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) বেশ কিছু সংগঠন। ওই তালিকার আটজনকে বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসন ওই উচ্ছেদ নোটিশ পাঠিয়েছে। সদর ভূমি কার্যালয় থেকে পাঠানো দখলদারের তালিকায় উল্লেখ করা হয়, নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে, অবাধে বালু তুলে এবং নদীর বহু স্থানে ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, বেআইনিভাবে নদীর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে ইকোপার্ক নির্মাণ, নদীর জায়গায় ইকোপার্কের ফটক নির্মাণ, পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া, বর্জ্য ফেলে নদী ভরাট, কাগজ কলের বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলে পানিদূষণ, নদীর বুকে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ড্রেজার যন্ত্র বসিয়ে অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে করতোয়া নদীর তিনটি অংশে দখলের কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ–সংলগ্ন মহিষাবান মৌজায় প্রায় ১৫ বিঘা আয়তনের নদীর জায়গা অবৈধভাবে দখল ও মাটি ভরাট করে ছাত্রাবাস ও ক্যানটিন নির্মাণ এবং নদীর জায়গা পুকুর হিসেবে ব্যবহার করার কথাও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বগুড়া শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে টিএমএসএস মহিলা মার্কেটের পূর্ব পাশে সূত্রাপুর মৌজায় করতোয়ার নদীর পশ্চিম তীর ভরাট করে টিএমএসএস অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে।

করতোয়া নদীর বুকে চলছে চাষাবাদ। সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্র এলাকায়।
করতোয়া নদীর বুকে চলছে চাষাবাদ। সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্র এলাকায়।

করতোয়া নদী ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। বগুড়া শহরের ভেতর দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ আড়াআড়িভাবে প্রবাহিত। আগে মূল করতোয়া নদীর সঙ্গে করতোয়ার সরাসরি সংযোগ ছিল। এখন উৎসমুখে জলকপাটের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে করতোয়ার পানিপ্রবাহ। পরিবেশবাদী ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করতোয়ার অবস্থা খুবই নাজুক। উৎসমুখে জলকপাটের কারণে নদীটি অনেক আগেই নাব্যতা হারিয়েছে। এখন পাল্লা দিয়ে চলছে নদীর জায়গা দখল ও পানিদূষণ।
জানতে চাইলে টিএমএসএসর নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে করতোয়া নদীপারের জায়গায় তিনি টিএমএসএস ছাত্রাবাস ও ক্যানটিন নির্মাণ করেছেন। জেলা প্রশাসন সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে টিএমএসএস আইনের আশ্রয় নেবে। নদীতে বিসিএল পেপার মিলের বর্জ্য ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কাগজ কলে ইটিপি চালু রয়েছে। কালভার্টের নিচে নর্দমা দিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁর তরল বর্জ্য ফেলা হতে পারে।
হোসনে আরা দাবি করেন, নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতেই পরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হচ্ছে। ইকোপার্ককে ঘিরে করতোয়া নদীর চার কিলোমিটার অংশকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। নদীর স্রোতোধারা বাধাগ্রস্ত করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। নদীর বুকে দ্বীপের আদলে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন স্থানটি টিএএমএসএস নিজস্ব জায়গা, নদীর সীমানা দ্বীপের ওপারে। এমএসএসের কিছু জায়গা করতোয়ায় বিলীন হয়েছে, জায়গা ভরাটে নদীর ধারে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।
সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) তমাল হোসেন বলেন, টিএমএসএসের বিরুদ্ধে করতোয়া নদীর একাধিক স্থানে দখল, ভরাট ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে টিএমএসএস মেডিকেল কলেজের পেছনে মহিষাবান মৌজায় ৪ দশমিক ৯০ একর নদীর জায়গা দখল করে ছাত্রাবাস, ক্যানটিনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের প্রমাণ মিলেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, বিসিএল পেপার মিলের ইটিপি বন্ধ রেখে বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলা হলে তদন্ত করে টিএমএসএসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পৌর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মালতিনগর ভাটকান্দি সেতু–সংলগ্ন এলাকায় নদী দখল করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ ও পানির পাম্প স্থাপন এবং কালেক্টরেট স্কুল–সংলগ্ন স্থানে নদীর জায়গা ভরাট করে পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে।
পৌরসভার মেয়র এ কে এম মাহবুবর রহমান বলেন, নদীপারের জায়গা খালি ছিল বলে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করেছে পৌরসভা। প্রশাসনের নোটিশ পেলে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলীমূন রাজীব বলেন, ইতিমধ্যে তৈরি করা তালিকা চূড়ান্ত নয়। করতোয়া নদী দখলকারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তবে ৩০ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চলবে। নতুন করে আরও দখলদার চিহ্নিতকরণের কাজও চলবে।
জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ বলেন, নদী কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক নদী দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।