তক্তা বিছিয়ে পর্যটক ওঠা-নামা

টেকনাফ থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজের যাত্রীরা সেন্ট মার্টিনের জরাজীর্ণ জেটিতে নামছেন ঝুঁকি নিয়ে। গত রোববার দুপুরে।  প্রথম আলো
টেকনাফ থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজের যাত্রীরা সেন্ট মার্টিনের জরাজীর্ণ জেটিতে নামছেন ঝুঁকি নিয়ে। গত রোববার দুপুরে। প্রথম আলো

১১ বছরেও সংস্কার হয়নি টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ওঠা–নামার একমাত্র জেটিটি। এই জেটিতে ইতিমধ্যে তিনটি গার্ডার, জেটির দুই পাশের রেলিং ও পন্টুন পয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ জেটির সঙ্গে গাছ পুঁতে রেখে ভেড়ানো হচ্ছে পর্যটকবাহী জাহাজ ও মাছ ধরার ট্রলার। ট্রলার ও জাহাজ থেকে প্রতিদিন সাত হাজারের বেশি মানুষ জেটিতে ওঠা–নামা করছেন কাঠের তক্তা বিছিয়ে এবং বাঁশের ওপর ভর করে।
গত সোমবার ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিপাত শুরু হলে ঝুঁকিপূর্ণ জেটিটি দুলতে থাকে। এ সময় জেটিতে বাঁধা ট্রলারগুলো ভয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। ঝুঁকির কারণে ওই দিন টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী সাতটি জাহাজ সেন্ট মার্টিন জেটিতে পৌঁছাতে পারেনি। আগের দিন রোববার সেন্ট মার্টিনে যাওয়া তিন হাজার পর্যটক সেখানে আটকা পড়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আটকে পড়া পর্যটকদের জাহাজে টেকনাফ ফিরিয়ে আনা হয়।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোশিয়েন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেটিটি সংস্কারের জন্য বহু আবেদন–নিবেদন হয়েছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অথচ প্রতিবছর জেটি ইজারা দিয়ে কোটি টাকা আয় করছে সংশ্লিষ্ট মহল। জেটি ধসে প্রাণহানি ঘটলে তখন ‘ঘুম’ ভাঙতে পারে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেটির উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ পাশের তিনটি গার্ডার ভেঙে সাগরে পড়ে গেছে। জাহাজ মালিকেরা ওই স্থানে বড় বড় গাছ পুঁতে জেটির সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। জাহাজ থেকে জেটিতে ওঠা–নামা করার জন্য বিছানো হয়েছে কাঠের তক্তা। অন্যদিকে জেটির পন্টুন আলাদা হয়ে পড়ায় সেখানে বালুর বস্তা ফেলে রাখা হয়েছে। সাড়ে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের এ জেটির বিভিন্ন অংশে রেলিংও নেই।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) টেকনাফ কার্যালয় সূত্র জানায়, এলজিইডির তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০২-০৩ অর্থবছরে সাড়ে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থের এই জেটি নির্মাণ করা হয়। পরে এটি তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা পরিষদকে।
সেন্ট মার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে জেটিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর দীর্ঘ ১১ বছরেও জেটির সংস্কার হয়নি। এ জেটি ব্যবহার করে প্রতিদিন ছয় থেকে আট হাজার পর্যটক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওঠা–নামা করছেন।
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল মান্নান দ্বীপ সফরে আসেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাহিদুর রহমান ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল হাসান। এ সময় জেটির বেহাল দশা দেখে বিভাগীয় কমিশনার ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সেন্ট মার্টিনের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, জেটি নির্মাণের শুরু থেকে প্রতিবছর জেলা পরিষদ এ জেটি ইজারা দিয়ে ৪৭ লাখ টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করছে। অথচ ঝুঁকিপুর্ণ জেটিটি সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেই।
কুমিল্লা ও ঢাকার মগবাজার থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক ছিদ্দিকুর রহমান ও মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন,‘জেটিটি এখন পর্যটকদের জন্য মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। আমাদের জীবনের কী কোনো মূল্যে নেই? অথচ এ জেটি পারাপারে জনপ্রতি ৭০ টাকা ইজাদার আদায় করেন। জাহাজ থেকে জেটিতে নামতে গিয়ে ভয়ে বহু নারী ও শিশুর কান্নাকাটিও দেখেছি।’
পর্যটকবাহী জাহাজ কেয়ারি সিন্দাবাদের টেকনাফের ব্যবস্থাপক শাহ আলম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেটি নিয়ে আতঙ্কে থাকেন দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা। পর্যটকের নিরাপত্তার স্বার্থে জেটিটির সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে এলজিইডি টেকনাফ উপজেলা প্রকৌশলী চৌধুরী মোহাম্মদ আসিফ রেজা বলেন, জেটিটি মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে স্থাপনা নির্মাণের ওপর পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এলজিইডিও কিছু করতে পারছে না। তবে এ জেটি নির্মাণের পর রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কারের দায়দায়িত্ব জেলা পরিষদের।
কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলা ও পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য জেটিটি সংস্কার খুবই জরুরি।
এ জন্য ১০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার কারণে জেটির সংস্কারকাজ শুরু করা যাচ্ছে না। বিষয়টি সুরাহার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।