পলান সরকারের জানাজায় মানুষের ঢল

কাছের মানুষ, দূরের মানুষ সব যেন পলান সরকারের জানাজায় এসে একাকার হয়ে গেলেন। সব মানুষই যেন বইয়ের টানে এসেছিলেন। যাঁর ভেতরে বইপ্রেম আছে, দূর থেকে হলেও তিনি এসেছিলেন পলান সরকারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। এতেই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় মাঠ। প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এস এম আব্দুল কাদের।

পলান সরকারের জানাজার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ১০টা, কিন্তু দূর থেকে আসা মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং স্মৃতিচারণার কারণে নির্ধারিত সময় গড়িয়ে যায়। জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ১০টা ১৮ মিনিটে।

পলান সরকারের জানাজায় যোগ দিতে মানুষের ঢল। ছবি: প্রথম আলো
পলান সরকারের জানাজায় যোগ দিতে মানুষের ঢল। ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী থেকে বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা নিয়ে যান রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এস এম আব্দুল কাদের। তিনি পলান সরকারকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। শোকবার্তাটি তাঁর পারিবারের সদস্যদের হাতে পৌঁছে দেন। এ সময় তিনি বলেন, পলান সরকারের গড়া বিদ্যালয়টি তাঁরা সরকারীকরণের ব্যবস্থা করবেন। এই বিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি ভবন তৈরি করবেন। তিনি পলান সরকারের বইপড়ার আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ। এ সময় তিনি বলেন, দেশ একজন গুণী মানুষ হারাল। নিভৃত এলাকায় থেকে পলান সরকার সারা দেশে শিক্ষার আলো জ্বেলেছিলেন।

স্মৃতিচারণামূলক বক্তব্য দেন বাঘা উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দীন। পলান সরকারের আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কথা তুলে ধরেন প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ। কথা বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান, বাউসা কলেজের অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ, পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর ছেলে হায়দার আলী প্রমুখ। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাবা বিশিষ্ট সমাজসেবক শামসুদ্দিন পলান সরকার স্মৃতি পাঠাগার স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন।

জানাজা শেষে পলান সরকার পাঠাগারের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

শুক্রবার (১ মার্চ) রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে নিজ বাসভবনে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পলান সরকার শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর।

পলান সরকারের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর প্রকৃত নাম হারেজ উদ্দিন। কিন্তু তিনি পলান সরকার নামেই পরিচিতি পান। নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক পান। গত ৮ ডিসেম্বর পলান সরকারকে বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ-২০১৮ প্রদান করা হয়।

২০০৭ সালে সরকারিভাবে তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে তাঁকে অসংখ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে নিয়ে ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামে শিমুল সরকার একটি নাটক নির্মাণ করেছেন। চ্যানেল আই তা প্রচার করেছে। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে পলান সরকারের বই পড়ার আন্দোলন নিয়ে লেখাটি সারা পৃথিবীর ৪০টি প্রধান দৈনিকে ছাপা হয়।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পলান সরকারকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়। ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এটি প্রদর্শিত হয়। এরপর থেকে দেশের ১০টি টেলিভিশন চ্যানেল কয়েক দিন ধরে এই তথ্যচিত্র প্রচার করে।

২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ছুটির দিনে’ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’। এটিই তাঁকে নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদন। তার আগে ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।