ত্বকীসহ ওসমান পরিবারের করা সব হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলেন মেয়র আইভী

ত্বকী হত্যার ষষ্ঠ বার্ষিকী স্মরণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জয়ীদের পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ, নারায়ণগঞ্জ, ৬ মার্চ । ছবি: দিনার মাহমুদ
ত্বকী হত্যার ষষ্ঠ বার্ষিকী স্মরণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জয়ীদের পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণ, নারায়ণগঞ্জ, ৬ মার্চ । ছবি: দিনার মাহমুদ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, বিশেষ পরিবার দ্বারা হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে বলেই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার বিচার হচ্ছে না। কারা ত্বকীকে হত্যা করেছে সেটি প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ সারা দেশের মানুষ জানে।

বুধবার বিকেলে নগরীর দেওভোগে জিমখানা শেখ রাসেল নগর পার্কের মুক্তমঞ্চে ত্বকী হত্যার ষষ্ঠ বার্ষিকী স্মরণে শিশু সমাবেশ ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সেলিনা হায়াৎ আইভী এসব কথা বলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র আইভী বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করব, ত্বকী হত্যার বিচার করা হোক। পাশাপাশি ওসমান পরিবার দ্বারা চঞ্চল, আশিক, মিঠু, ভুলসহ সব হত্যার বিচার চাই। ত্বকী হত্যার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত বিচারের দাবি জানিয়ে যাব, ঘাতক খুনি পরিবারকে আমরা প্রত্যাখ্যান করে যাব।’

মেয়র আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের আরেকটি ভূখণ্ড মনে হয়। এখানে নির্বিচারে হত্যা করা হবে, অত্যাচার করা হবে, অবিচার করা হবে—কিন্তু বলার কেউ নেই। নারায়ণগঞ্জবাসীকে স্তব্ধ ও ভয় দেখানোর জন্য একের পর এক হত্যাকাণ্ড করা হলেও যখন এই শহরের মানুষ সোচ্চার তখন শিশু ত্বকীকে হত্যা করা হয় তার পিতা-মাতাসহ সবাইকে ভয় দেখানোর জন্য। জুজুর ভয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী যাতে চুপ হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জবাসী তো চুপ হয়নি বরং খুনিদের মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ প্রতিবাদ করতে শিখেছে। ১৪ মাস আগে অপহৃত ছাত্রলীগের নেতা এপনের দেড় বছরের ছেলে সাদমান সাকিবকে উদ্ধারে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমরা জানি ত্বকীর হত্যাকারী কারা, আপনিও জানেন ত্বকীর হত্যাকারী কারা? কিন্তু বিচারটি কেন করছেন না? সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে হাজির করা হয়নি এখন। সাত বছরে ৬২ বার পেছানো হয়েছে। হত্যার বিচারে কেন আপনার সরকারের এত দ্বিধা। আপনার সরকার যদি হত্যাকাণ্ডের বিচার না করতে পারে, খুনিদের যদি বিচার না করতে পারে, আপনার উচ্চারিত গণতন্ত্র, আপনার গর্বের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে আইনের শাসন। আইনের শাসন অন্ধের মতো কাজ করে।’

অধ্যাপক শওকত আরা হোসেন বলেন, সত্য ও সুন্দরের পক্ষে চলত বলে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। ত্বকী হত্যাকারীদের বিচারে কেন ছয় বছর লাগবে? দেশে কী আইনের শাসন নেই? সরকারপ্রধানের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনার ওপর ছয় বছর আগে যে দায়িত্ব এসেছে সেই দায়িত্বটি পালন করবেন। আপনার শাসনামলেই ত্বকী হত্যার বিচার করবেন।’

সভাপতির বক্তব্যে রফিউর রাব্বি বলেন, ‘ত্বকীকে অপহরণের পর প্রথমে সায়াম প্লাজায় এক অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত সাড়ে নয়টায় আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। র‌্যাবের অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে আজমেরী ওসমানের টচার সেলে তার উপস্থিতিতে ত্বকীকে নির্যাতনের পর হত্যা করেছে। আমরা বরাবর বলে আসছি, এই তিন ঘণ্টা ত্বকী কোথায় ছিল? কীভাবে ছিল? এই রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে হবে—এটি অভিযোগপত্রে থাকতে হবে। আমরা জোর দিয়ে বারবার বলছি, এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা শামীম ওসমান এবং এই হত্যার সঙ্গে তার ছেলে অয়ন ওসমান জড়িত এবং তারা সম্মিলিতভাবে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে। এই পরিবারটি শুধু ত্বকীকে হত্যা করেছে তা নয়, তারা নারায়ণগঞ্জে স্বাধীনতার পর থেকে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। ত্বকীর আগে এই পরিবার বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। তারা হত্যাকাণ্ড এই কারণে করে, মানুষ যাতে তাদের ভয় পায়। ভয়ে তারা যা বলে, মানুষ যাতে তা করে। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য হত্যাকাণ্ডগুলো বছরের পর বছর তারা করে যাচ্ছে। এই পরিবারটি যে খুনি পরিবার এটি উন্মেচিত হয়েছে ত্বকী হত্যার পর। এর আগে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হলেও এই পরিবারটি খুনি পরিবার হিসেবে দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল না। জামতলায় মিঠুকে আজমেরী ওসমানের উপস্থিতিতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মিঠুর পরিবার থানায় মামলা করতে গেলে আজমেরী ওসমানের নাম থাকায় পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আজমেরী ওসমানের নাম বাদ দিয়ে তার মামলা নিয়েছে পুলিশ। বারবার বিভিন্ন সময় প্রশাসন থেকে রাষ্ট্র থেকে এই পরিবারের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াতে এই পরিবারটি বেপরোয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের লাশের পর লাশ ফেলেছে এই পরিবার। নারায়ণগঞ্জে যারা মাদকের ব্যবসা, চাঁদাবাজি করে তারা এই পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় করে। যারা পরিবহনের চাঁদা খায় এই পরিবারের পৃষ্ঠপোষতায়। লাশের পর লাশ ফেলে এই পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় করে। তারপরও তারা সন্ত্রাস, মাদকবিরোধী সমাবেশ করে। কতটা নিলজ্জ হলে তারা এটি করতে পারে।’

চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলের ১৫০ জন্য শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে তিনটি বিভাগে ৩০ জনকে পুরস্কার প্রদান করা হয়।

নিহত ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির সভাপতিত্বে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরিচালক জাহিদ মোস্তফা, চিত্রশিল্পী অশোক কর্মকার, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, সাবেক সভাপতি ও সদস্যসচিব হালিম আজাদ প্রমুখ।

এর আগে সকালে নারায়ণগঞ্জের পুরান বন্দর এলাকায় সিরাজ শাহ্র আস্তানায় ত্বকীর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিটি মেয়র আইভী, নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বিসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশ নেন।