নারীর আয়ে বদলে গেছে পুরো পাড়ার চিত্র

কাঁথা সেলাই করছেন এক নারী। সম্প্রতি উত্তর কালশীতে।  ছবি: প্রথম আলো
কাঁথা সেলাই করছেন এক নারী। সম্প্রতি উত্তর কালশীতে। ছবি: প্রথম আলো

বিকেল হতেই সুই, সুতা আর কাঁথা নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে হাজির হন চম্পা রানী সরকার। ততক্ষণে দুধ বিক্রি করে শাশুড়ি সেবা দাসী সরকারও সেখানে চলে আসেন। তাঁরা জীবনজীবিকার গল্পে গল্পে ফোঁড় তোলেন কাঁথার জমিনজুড়ে।

সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া উত্তর কালশীর হিন্দুপাড়ায় ঢুকলেই রোজ বিকেলে এ দৃশ্য চোখে পড়বে। কাঁথা সেলাই করে চম্পার রোজগার মাসে হাজার চারেক টাকা। তবে গরুর দুধ বিক্রি করে শাশুড়ির আয় কিছুটা বেশি। চম্পার স্বামী ছোটখাটো চাকরি করেন। তিনজনের আয়ে বেশ ভালোভাবেই তাঁদের সংসার চলছে।

তবে একসময় তিনবেলা খাবারও খেতে পেতেন না এ পরিবারের সদস্যরা। থাকতেন পরের ঘরে। সেবা দাসী সরকার জানান, তাঁর স্বামী আবার বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেলে দুই ছেলেকে নিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়েন। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে ঠাঁই নেন ভাইয়ের পরিবারে। ভাইয়ের রোজগার কম, পরিবারে সদস্যসংখ্যা সাত। এই পরিস্থিতিতে এক আত্মীয়ের পরামর্শে দুধ বিক্রি শুরু করেন সেবা দাসী। স্থানীয় খামার থেকে গরুর দুধ কিনে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। সেই আয়েই তাঁর সংসার চলে। কয়েক বছরের ব্যবধানে নিজে ঘর তোলেন। ছেলেদের স্কুলেও পাঠান। ঘটনাটি বছর ৩০ আগের। তখন এই পাড়ায় হাতে গোনা দু–একজন নারী আয়রোজগার করতেন।

বর্তমানে কেবল চম্পা বা সেবা দাসী নন, হিন্দুপাড়ার অধিকাংশ নারী অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। পাড়ার পূজা কমিটির হিসাবমতো, এ পাড়ায় ১৩০টি পরিবারের বসবাস। এসব পরিবারের ৯০ শতাংশ নারী অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। পাড়ায় মোট ৩২টি ঘরে সেলাই মেশিন আছে। দুধ বিক্রি করেন ৩৫ জন নারী। তাঁদের মাসিক আয় ৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। কয়েকজনের আয় অবশ্য আরও বেশি।

এখানকার নারীরা মূলত গরুর দুধ বিক্রি, সেলাইয়ের কাজ, কাপড়ের ব্যবসা, ক্রোকারিজের ব্যবসা করেন। কেউ চাকরি করেন। অনেকে প্রাইভেট পড়িয়েও রোজগার করেন।

পাড়ার বয়স্ক ব্যক্তিরা জানান, প্রায় দেড় শ বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এখানে বসতি গড়েছেন। তাঁরা মূলত মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ থেকে নৌপথে এখানে আসেন। শুরুতে তাঁরা তুরাগ নদে মাছ ধরে এবং তুলসী কাঠের মালা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। কেউ কেউ অবশ্য বাড়িতে গরু পালন করতেন। সে আয়ে তাঁদের তিনবেলা খাবার জুটত না। শিক্ষার ছোঁয়া থেকেও তাঁরা দূরে ছিলেন। তবে বছর ১৫ ধরে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তনের হাওয়া খুব বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে সাত–আট বছর। এখন প্রতিটি পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। বিলাসিতা না থাকলেও অভাব নেই।

বাসিন্দা চন্দনা সরকারের কথায়, ‘আমরা ছিলাম হতদরিদ্র। পড়াশোনা দূরের কথা, ভাতের অভাবে কত যে কান্নাকাটি করেছি।’ এ পাড়ার নারীরা ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়ায় তাঁদের আর্থিক পরিবর্তন এসেছে বলে দাবি পাড়াবাসীর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারীদের আর্থিক কাজে অংশগ্রহণে পুরুষেরা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। তাই কাজ করতে গিয়ে বাইরে নানান কাঠখড় পোড়াতে হলেও ঘরে বেশ সহযোগিতা পান নারীরা। ঘরের কাজেও অনেক সময় সহযোগিতা করেন পুরুষেরা।

কাঠমিস্ত্রি অম্রিকা মল্লিক বলেন, ‘আমি যখন একা আয় করতাম, তখন সংসারে অভাব ছিল। প্রতি মাসেই ঋণ করে চলতে হতো। স্ত্রী আয় শুরুর পরে এখন অনেক ভালো আছি।’ তাঁর স্ত্রী মানিক্কি রানী মল্লিক বছর দশেক ধরে গরুর দুধ বিক্রি করেন।

সম্প্রতি এক দুপুরে পাড়াটি ঘুরে দেখা যায়, কোনো নারী পাঞ্জাবিতে নকশা তুলছেন। কেউ কেউ ঘরঘর শব্দ তুলে সেলাই মেশিন চালিয়ে কামিজ সেলাইয়ের কাজ করছেন। কেউ–বা দুধের কলস কাঁখে নিয়ে বের হচ্ছেন, কেউ আবার বিক্রি শেষে ঘরে ফিরছেন। আবার পাড়ার মুখে নিজের দোকানে ক্রেতার চাহিদামতো চা বানাতে ব্যস্ত মনেকা সরকার। তবে দল বেঁধে কাঁথা সেলাইয়ের দৃশ্য মুহূর্তেই গ্রামীণ পরিবেশকে মনে করিয়ে দেয়।

হিন্দুপাড়ার পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতি খগেন্দ্র চন্দ্র সরকার প্রথম আলোকে বলেন, নারীরা আয় করছে। বিষয়টি কেবল এ পাড়া নয়, সমাজের জন্য ইতিবাচক। এতে পাড়ার বাসিন্দাদের জীবন মান বেড়ে গেছে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার এ যাত্রায় তাঁরা সব সময় পাশে থাকতে চান।