লাভে থেকেও দাম বাড়াতে চায় গ্যাস কোম্পানিগুলো

>

.গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব
.রান্নার চুলা থেকে সিএনজিসহ সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর সোমবার থেকে গণশুনানি শুরু

রান্নাঘরে যাঁদের গ্যাসের চুলা একটি, তাঁরা এখন মাসে বিল দেন ৭৫০ টাকা। যাঁদের বাসায় দুই চুলা, তাঁরা বিল দেন ৮০০ টাকা। আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস বিল বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। এই প্রস্তাব নিয়ে আগামীকাল সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গণশুনানি করবে বিইআরসি। এতে কোম্পানিগুলোর দেওয়া প্রস্তাব অনুমোদন হলে এক চুলার জন্য গ্রাহকের ব্যয় হবে ১০০০ টাকা, দুই চুলার ক্ষেত্রে ১২০০ টাকা।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে থাকলে বিইআরসির আইন অনুযায়ীই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে না। দেশে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি একটি। আর বিতরণ কোম্পানি তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলীসহ ছয়টি। এর মধ্যে একটি (সুন্দরবন) ছাড়া বাকি পাঁচটি কোম্পানিই লাভে রয়েছে। একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলও লাভে আছে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে আইনের লঙ্ঘন হিসেবেই দেখছেন তাঁরা।

জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে বিইআরসি। গত বছরের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল, তবে ওই দাম গ্রাহককে দিতে হয়নি। সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী বাড়তি দাম (এক বছরের জন্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা) সরকার দিয়েছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী একবার মূল্যবৃদ্ধির ১২ মাসের মধ্যে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিতে পারে না সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। আর যদি দেয়ও, তাহলে বিইআরসি তা বাতিল করে দেবে, শুনানি করার সুযোগ নেই।

গ্রাহক পর্যায়ের পাশাপাশি যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজির (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম প্রতি ইউনিট (প্রতি ঘনমিটার) ৩২ টাকা থেকে ৪০ টাকা, শিল্পকারখানার বিদ্যুৎকেন্দ্রে (ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র) সরবরাহ করা গ্যাস (প্রতি ইউনিট ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা ৭০ পয়সা) এবং সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম (প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ১৬ পয়সা থেকে ৭ টাকা ৬৬ পয়সা) বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে বিইআরসির কাছে।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার কঠোর সমালোচনা করেছে বিএনপি, সিপিবি। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানিয়েছে। জনস্বার্থের চেয়ে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধ্যান্য দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে তারা।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিতরণ সংস্থাগুলো একটি প্রস্তাব দিয়েছে, আমরা সে অনুযায়ী গণশুনানির আয়োজন করেছি। গ্যাসের দাম বাড়বে কি না, সেটি গণশুনানিতে আলোচনা শেষে বিইআরসি তার পদ্ধতি অনুযায়ী ঘোষণা দেবে।’

বিইআরসিতে দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন করে গ্যাসের দাম না বাড়ালেও চলতি অর্থবছরে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ৫৫০ কোটি টাকা মুনাফা করবে। প্রস্তাবে তিতাস বলেছে, গ্যাসের দাম না বাড়ালে মুনাফা কম হবে, সে কারণে লভ্যাংশ দেওয়া (শেয়ার গ্রহীতাদের) সম্ভব হবে না। একইভাবে জালালাবাদ (বার্ষিক মুনাফা ১০০ কোটি টাকা), পশ্চিমাঞ্চল (বার্ষিক মুনাফা ৫১ কোটি টাকা), কর্ণফুলী (বার্ষিক মুনাফা ২৪৭ কোটি টাকা)। বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লাভ–লোকসানের পূর্ণাঙ্গ তথ্য বিইআরসিকে দেওয়া প্রস্তাবে উল্লেখ করেনি। এর বাইরে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লোকসানে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো কুষ্টিয়া–ঢাকা পাইপলাইন স্থাপন। এটি স্থাপনে কোম্পানিটি ৫৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলের বার্ষিক মুনাফা ১৬ কোটি টাকা।

জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানোর চন্য বিইআরসি যে গণশুনানি করে, তা লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবারও দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানিতে আমরা প্রমাণ করেছিলাম, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে রয়েছে, কিন্তু বিইআরসি ঠিকই গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। আসলে আগে থেকেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে গণশুনানি করে বিইআরসি।